দশ বারজন নেতৃস্থানীয় লোক সালারের কামরায় প্রবেশ করল। সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যুবতীর উপর। অথচ যুবতী নির্বিকার নিশ্চুপ! পিট পিট করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ভাব লেশহীনভাবে বসে আছে।
সালার জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
যুবতী উত্তর দিল, আমার নাম ইউকেলিস।
কামরায় বসা লোকেরা কানাঘুষা করতে লাগল। একজন বলল, এতো পুরুষের নাম। এ ধরনের নাম রোমানরা রাখে।
যুবতী বলল, আমি ইউকেলিস। আর ইউকেলিস হল রোজী। ইউকেলিস জীবিত আছে আর রোজীকে হত্যা করে ফেলেছে।
সালার জিজ্ঞেস করল, রোজীকে কে হত্যা করেছে?
যুবতী উত্তরে বলল, হিরাক্লিয়াস। আমি হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করতে যাচ্ছি। আমি তার খুন পান করব। তোমাদের কেউ পারলে আমাকে ঐ পথ দেখিয়ে দাও যে পথে গেলে আমি হিরাক্লিয়াসকে পাব।
সালার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি মৃত মানুষের রূহ, না জীবিত মানুষ?
যুবতী বলল, ইউকেলিস আমার রূহ। ইউকেলিসের রূহ আমার মাঝে নিহিত রয়েছে।
সালার জিজ্ঞেস করল, তুমি কার মেয়ে? তোমার পিতার নাম কি? কোথা থেকে এসেছো? সে আর কিছু বলতে পারল না, যা কিছু বলল তা অর্থহীন। সালার বুঝে ফেললেন, এই যুবতীর বিবেক-বুদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। উন্মাদনা তাকে আরষ্ট করে রেখেছে।
***
সালার দারুণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। যুবতী নারী, ঠিকানা বলতে পারে না। নিকটাত্মীয় কেউ নেই। তা ছাড়া এ ধরনের রোগীর কোন চিকিৎসকও তার জানা নেই। কি করা যায়। আর এ কথা তো চিন্তাও করা যায় না যে,একজন যুবতী নারীকে পাগল জেনে তাকে ঘর থেকে বের করে দিবে।
মানুষের সামনে যুবতাঁকে উপস্থিত করার কারণে শহরবাসীদের মাঝে যে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজমান ছিল তা দূর হয়ে গেল। সবাই জানল, আসলে কোন জ্বীন, বদরূহ বা ডাইনী নয়। একজন পাগলী যুবতী এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। যদি যুবতী তার নামধাম ও ঠিকানা বলতে পারত তাহলে সালার তাকে তার পিতামামার নিকট পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারত। এ অবস্থায় যদি মুসলমান সালার না হয়ে কোন রোমান সালার হত তাহলে উন্মাদিনী ও পাগলিনী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাকে হত্যার নির্দেশ দিত। তারপর তার লাশ কোথাও ফেলে দিত। কিন্তু ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কোন সালার বা অফিসারের কথা চলে না। বরং ইসলামের বিধান অনুযায়ী তাদের চলতে হয়। এ ক্ষেত্রে তাদের কোন ত্রুটি প্রকাশিত হলে তাদেরও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়।
সালার রোজীকে তার সাথে তার বাড়িতে নিয়ে গেল এবং মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে বললো, একে গোসল করিয়ে ভাল কাপড় পরাও এবং খেতে দাও।
সালার ফিরে এসে শহরের সমবেত লোকদের মাঝে উপস্থিত হলেন।
সালার বললেন, আপনারা শহরের গণ্যমান্য মানুষ। আপনারা আমাকে পরামর্শ দিন, আমি এখন কি করতে পারি। আমি এ যুবতী নারীকে ঘরেও রাখতে পারছি না। আবার তাকে বাইরেও বের করে দিতে পারছি না। তার দেখাশুনা ও তার ইজ্জত আব্রুর হিফাজত করা আমাদের কর্তব্য। আমি তাকে কোন মুখলিস হামদর্দ ব্যক্তির নিকট অর্পণ করতে চাচ্ছি যে তাকে তার বাড়িতে রাখবে। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। হতে পারে সে ভাল হয়ে যাবে। ভালো হয়ে উঠলে সে তার পিতামাতার নামধাম বলতে পারবে। তখন একটা ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে।
সালারের কথার পর মজলিসে নিরবতা নেমে এল। টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। তার অর্থ কেউ এ উন্মাদিনীর দায়িত্ব নিতে রাজী নয়। সে মজলিসে সবার পিছনে তিন ব্যক্তি বসে ছিল। তারা কানাঘুষা করে কি যেন বলছে।
তাদের একজন হামদর্দীর সাথে বলল, জনাব আমীর! আমরা তিনজন মিশর থেকে এসেছি। কাজ শেষে এখন আমরা ফেরার পথে। লোকমুখে শুনতে পেলাম, এক বদরূহকে ধরে আনা হয়েছে। অনুসন্ধিৎসু মন ধরে রাখতে পারলাম না। দেখতে এলাম। বদরূহের জায়গায় এক উন্মাদিনীকে দেখতে পেলাম। আমরা নিশ্চিত এ যুবতী মুসলমান নয়। কোন খ্রিস্টান কবিলার মেয়ে। আমরা মিসরের খ্রিস্টান। যদি আপনি আমাদের বিশ্বাস করেন, তাহলে আমরা একে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারি। আমরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। ভাল হলে তাকে তার পিতামাতার নিকট পৌঁছে দিব। আর যদি সে শাদী করতে চায় তাহলে মিশরে তার শাদীর ব্যবস্থা করব। যুবতী নারী নিয়ে চলা ভারি বিপদ জেনেও আমরা পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বলছি, যুবতীটি খ্রিস্টান আর আমরাও খ্রিস্টান। তাই তাকে আমরা আমাদের জিম্মায় নিতে চাচ্ছি। আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা তার দেখাশোনা ও চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করব।
উপস্থিত লোকদের তিন চারজন খ্রিস্টানের কথা সমর্থন করল। অন্যরাও মৌন সমর্থন দিল। ফলে সালারও এই ফয়সালাই করলেন। যুবতাঁকে তাদের নিকট সমর্পণ করার হুকুম দিলেন।
সালার জিজ্ঞেস করলেন, তবে যদি মেয়েটি তোমাদের সাথে যেতে না চায়, তাহলে কি হবে?
লোকটি বলল, মহামান্য আমীর! মেয়ের মাথায় কোন বুদ্ধি নেই। কল্যাণ অকল্যাণ কিছুই সে বুঝে না। তার মাথায় এ কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, সে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করতে যাচ্ছে। আমি তাকে বলব, তুমি আমাদের সাথে চল, আমরা তোমাকে আমাদের সাথে রাখব। তারপর আমরা সবাই মিলে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করব।
তার কথা শুনে সবাই প্রীত হল। বুঝল, লোকটি দারুণ বুদ্ধিমান ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন।
সালারের নির্দেশে যখন মেয়েটিকে আবার সালারের কামরায় আনা হল, তখন সে গোসল করে খেয়ে দেয়ে সুন্দর কাপড় পরিধান করে এসেছে। এবার তাকে দেখা মাত্র সবার চোখ স্থির হয়ে গেল। যেন রাজকুমারী, অপরূপ তার দেহলতা। মন কাড়া তার রূপ সুষমা। চেহারায় নিষ্পাপ ভাব প্রকট হয়ে আছে। সালার মেয়েটিকে বলল, আমি তোমার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তিনজন লোক তৈরী করেছি, এরা তোমার সাথে থাকবে এবং হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করবে।