প্রতিনিধি দলের কথা শুনে ও চেহারা দেখে সালার বুঝতে পারলেন, এরা এ সূক্ষ্ম বিষয়টি বুঝবে না। সহজে মেনেও নিবে না। এত গভীর জ্ঞান তাদের নেই। তাই তিনি একজন মুজাহিদ বাহিনীর সাহসী অফিসারকে ডেকে পাঠালেন। নির্দেশ দিলেন, তুমি তোমার সাথে যে কয়জন মনে চায় মুজাহিদ নিয়ে যাও এবং এই যে বদরূহ বা ডাইনী যার আলোচনা শহরে ছড়িয়ে গেছে তার রহস্য উৎঘাটিত করো।
প্রতিনিধি দলের একজন বলল, মহামান্য সালার! আপনার ধর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। এ ব্যাপারে কিছু বলার অধিকারও আমার নেই। তবে আমার একটি অনুরোধ, আপনি আপনার অধিনস্তের কোন ক্ষতি করবেন না। হতে পারে, আপনার প্রেরিত সৈন্যদের দেখে তা অদৃশ্য হয়ে যাবে। আর যদি অদৃশ্য হয়ে না যায় তাহলে নিশ্চয় আপনার লোকেরা তাকে ধরতে গেলে তাদের ভীষণ ক্ষতি হবে। তাদের নিমিষে হত্যাও করে ফেলতে পারে।
সালার তার দুর্বল বিশ্বাসের কথা শুনে নির্বাক রইল। চেহারায় নির্ভিকতার আভা ফুটিয়ে তাদের আশ্বস্ত করতে চাইল। তারপর অফিসারদের বলল, যাও যে করেই হোক তাকে খুঁজে বের কর। যদি তোমাদের দেখে পালিয়ে যায় তাহলে তো কিছু করার নেই। আর যদি তোমরা তার নাগাল পাও, তাহলে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসো।
সেনা অফিসারটি নির্ভাবনায় এ দায়িত্ব নিজ জিম্মায় নিয়ে নিল। প্রথমে সে খোঁজ খবর নিল, এ বদরূহটি কোথায় কোথায় দেখা গেছে। অনেকে তিন চার জায়গার কথা বলেছে। তবে দুজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট জায়গার কথা বলেছে।
অফিসারটি বেশ কিছু সাহসী মুজাহিদ সাথে নিয়ে শহরের বাইরে চলে গেল। মুজাহিদদের চার পাঁচজন করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে যে সব স্থানে ঝোঁপ ঝাড় রয়েছে, টিলা রয়েছে তার চারদিকে ছড়িয়ে দিল।
সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে তার আলোক রশ্মি। ঠিক তখন মুজাহিদদের একটি দল ঝোঁপের আড়ালে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেল। বলছে, আমি হিরাক্লিয়াসের খুন পান করতে যাচ্ছি। এ দলটি আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র দলকে তাদের কাছে ডাকল। তারা কেঁপের চারদিক ঘিরে ফেলল। সামনে অগ্রসর হতে লাগল। তাদের অধিনায়ক বলে দিল, অন্তরে আল্লাহর দৃঢ় বিশ্বাস আর কুরআন তেলাওয়াত করতে থাকবে। এভাবে চারদিক থেকে মুজাহিদ বাহিনী সামনে অগ্রসর হতে লাগল। তারা বারবার সেই চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেল। মনে হচ্ছে, সে হেঁটে হেঁটে এক দিক থেকে অন্য দিকে যাচ্ছে।
তাদের অবরোধ একেবারে ছোট হয়ে এলে তারা দর্শকদের বর্ণনা মতই এক নারীকে দেখতে পেল। নারীটি তাদের দেখে ধীরে ধীরে পিছু হটে যাচ্ছিল। মুজাহিদদের অধিনায়ক আরো অগ্রসর হয়ে চিৎকার করে বলল, খবরদার! এক কদম লড়বে না! তারপরই বর্শা উঁচু করে তুলে ধরল। বলল, তুমি জ্বীন, বদরূহ বা ডাইনী হলে অদৃশ্য হয়ে যাও। আর যদি মানুষ হও তাহলে আত্মসমর্পণ করে চলে এসো। তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করা হবে না। আমরা তোমাকে ভয় পাচ্ছি না। তুমিও আমাদের ভয় পেয়ো না।
নারী চিৎকার করে বলল, আমাকে হিরাক্লিয়াস পর্যন্ত যেতে দাও। হিরাক্লিয়াস আমার খুন ঝড়িয়েছে। আমি তার খুন পান করব।
নেতৃস্থানীয় মুজাহিদ বলল, আমরা তোমাকে হিরাক্লিয়াসের নিকট পৌঁছে দেব। তুমি জান,আমরা হিরাক্লিয়াসের দুশমন। আমরাও তাকে হত্যা করতে চাই। আমরা তোমার সাথে লোক পাঠাব। সে তোমার সাথে হিরাক্লিয়াসের নিকট যাবে, তারা তোমার ইচ্ছা পূরণে সহায়তা করবে।
মুজাহিদ অধিনায়ক ঘোড়া থেকে নামলেন, বর্শা হাতে ধীর পদবিক্ষেপে সামনে অগ্রসর হলেন। কথার তালে তালে তিনি একেবারে মেয়েটির কাছে পৌঁছে তার বাহু শক্ত করে ধরে বললেন, আমাদের সাথে এসো। আমরা তোমার ইজ্জত আবরু রক্ষা করব।
যুবতী কোন প্রতিবাদ করল না। কোন শক্তিও প্রয়োগ করল না। সুবোধের মত অধিনায়কের সাথ চলে এল। মুজাহিদ অধিনায়ক একেবারে তার ঘোড়ার নিকট চলে এল এবং যুবতাঁকে তার ঘোড়ায় বসিয়ে দিল। ঘোড়ার লাগাম ধরে চলতে লাগল। ইতিমধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল মুজাহিদ সমবেত হয়ে গেছে। তারা সারি বেঁধে অধিনায়কের পিছনে পিছনে চলছে। তারা দেখল, যুবতী অত্যন্ত সুন্দরী। অনেকে আশংকা করছিল, যে কোন মুহূর্তে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে উধাও হয়ে যাবে। কিন্তু না, সে ঘোড়ার পিঠেই বসে রইল।
***
সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। চারদিকে আবছা আবছা অন্ধকার ক্রমেই ঘনিভূত হতে শুরু করছে। সালারের দুশ্চিন্তা ক্রমেই উদ্বেগের আকার ধারণ করতে লাগল। নানা দুশ্চিন্তা তাকে পেয়ে বসল। ভাবছে, যদি এ কোন জ্বীন বা অন্য কিছু হয় তাহলে তো তাদের ক্ষতিও করতে পারে। আর হতে পারে এ সময় পর্যন্ত তারা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইত্যাদি নানা দুশ্চিন্তায় তিনি যখন ঝিম খেয়ে বসে আছেন, ঠিক তখন প্রহরী এসে সংবাদ দিল, প্রেরিত অফিসার এক যুবতাঁকে গ্রেফতার করে এনেছেন। সালার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। হতবুদ্ধিতার রেশ কাটতে না কাটতেই অফিসারটি সেই যুবতাঁকে নিয়ে সালারের কক্ষে প্রবেশ করলেন।
ইতিমধ্যে শহরে এ সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সবাই দৌড়ে এল ডাইনীকে দেখতে। সালারের কক্ষের সামনে মানুষের ভিড়। সালারকে বলা হল, লোকেরা তার কামরার সামনে ভিড় করে আছে। তারা দেখতে চায় কাকে মুজাহিদরা গ্রেফতার করে এনেছে। কেমন সেই ডাইনী। ইতিমধ্যে সালার বুঝে ফেলেছেন, ডাইনী বদরূহ বা জ্বীন কিছুই নয়, সে একজন মানুষ। এক যুবতী নারী। সালার বললেন, যে নেতৃস্থানীয় লোকেরা এ সংবাদ নিয়ে এসেছিল তাদের ডেকে এ কক্ষে নিয়ে এসো। নেতৃস্থানীয় আরো কেউ থাকলে নিয়ে এসো।