ঝোঁপঝাড় খুব ঘন ছিল। মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু টিলাও ছিল। তাই আমি কিছুই দেখতে পাইনি। ভয়ে আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠল। আমি দ্রুত খচ্চর চালিয়ে চলে আসতে চাইলাম। কিন্তু খচ্চর তো আর ঘোড়া নয়, সে ধীর লয়ে চলতে লাগল।
আমি একটি টিলার পাশ দিয়ে আসার সময় হঠাৎ দেখলাম, এক যুবতী মেয়ে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। অগোছালো চুল। ভারী সুন্দরী। জায়গায় জায়গায় তার কাপড় ছিঁড়ে গেছে।
ভয়ে আতঙ্কে আমার মরণ দশা। ভাবলাম, এ বিজন প্রান্তরে এ যুবতীর তো থাকার কথা নয়। নিশ্চয় সে কোন মৃত যুবতীর বদরূহ বা কোন ডাইনী হবে। মানুষের রূপ ধরে আমার নিকট এসেছে। আমি ভয়ে খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। ডাইনীর সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালাম। একেবারে বিনীত কণ্ঠে বললাম, আমি এক গরীব মুসাফির। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত থাকি। আমাকে বলুন, আমি আপনার কি খেদমত করতে পারি। দয়া করে আমার কোন ক্ষতি করবেন না।
ডাইনী কোন কথা বলল না। সে সোজা খচ্চরের নিকট গেল। খচ্চরের কাঁধের সাথে বাঁধা এক থলেতে আমার কিছু খাবার ছিল। আর একটি মসকে কিছু পানি ছিল। সে খাবারের থলে আর মশকটি নিয়ে আমার সামনে এগিয়ে এল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, হিরাক্লিয়াস কোথায়?
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে এতটুকু শুনেছি যে, মুসলমানদের সাথে পরাজিত হয়ে শাম থেকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে তা বলতে পারি না। তবে মনে হয় সে মিশর গেছে। মিশরে এখনো তার বাদশাহী আছে। ইস্কান্দারিয়াতে তার একটি প্রাসাদও আছে। হয়তো সেখানেই চলে গেছে।
ডাইনী দাঁতে দাঁত পিষে বলল, আমি তাঁর খুন পান করতে যাচ্ছি। সে আমার খুন ঝরিয়েছে। সে আমাকে হত্যা করেছে। বল্ সে কোথায় আছে? অন্যথা আমি এখনই তোর খুন পান করব।
ভয়ে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমার মাসুম সন্তানদের আপনি এতীম বানাবেন না। আমি একজন গরীব মানুষ। রাজা বাদশাদের খবর আমি কী জানব। যদি আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন তাহলে তার উসিলায় আমাকে ক্ষমা করে দিন।
তারপর আর ডাইনী কিছু বলল না। খাবারের থলে আর পানির মশক নিয়ে চলে গেল। ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আর দেরি করলাম না। খচ্চরের উপরে লাফিয়ে উঠে চলে এলাম।
এর কিছুদিন পর ইন্তাকিয়াতে দুই মুসাফির পৌঁছল। তাদের অবস্থাও ঐ মুসাফিরেরই মত। ভয়, ভীতি আর আতঙ্কে তারা শেষ হয়ে গেছে। তারা লোকদের বলেছে, অমুক পথ দিয়ে যেন কেউ না যায়। কারণ সে পথে এক ডাইনী হন্যে হয়ে ঘুরছে। মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর চিৎকার দিচ্ছে। ডাইনী বলছে, সে হিরাক্লিয়াসের খুন পান করতে যাচ্ছে। কারণ হিরাক্লিয়াস তার খুন ঝড়িয়েছে।
বাতাসের আগে আগে এ সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছে, নিশ্চয় হিরাক্লিয়াস কোন যুবতাঁকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেছিল। এটা তারই বদরূহ। তবে কেউ এমন কথা বলেনি যে সেই বদরূহ কারো কোন ক্ষতি করেছে। বা কাউকে কোন ভয় দেখিয়েছে। সে যে মুসাফিরের সামনেই আত্মপ্রকাশ করেছে তার খাবার ও পানীয় নিয়ে গেছে।
এ অঞ্চলে যে ছোট ছোট দুচারটি কবিলা বাস করে তারাও এ চিৎকারের আওয়াজ শুনেছে। কিন্তু কেউ তাকে কোন বস্তীতে প্রবেশ করতে দেখেনি। ভয়ে লোকেরা সন্ধার পর ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সে শুধু মুসাফিরদের সামনেই আত্মপ্রকাশ করেছে এবং তাদের খাবার ও পানীয় নিয়ে গেছে। যারা তাকে দেখেছে, সবাই বলেছে সে দারুণ সুন্দরী, তার মাথার চুল অবিন্যস্ত। গায়ের কামিছটি ময়লা ও শত ছিন্ন।
বিভিন্ন মুসাফিরের মুখ থেকে যা শোনা গেছে তাতে অনুমান হয়েছে যে, সে ইন্তাকিয়ার দিকে যাচ্ছে।
***
সে যাই হোক, বদরূহ হোক, ডাইনী হোক বা পাগল যুবতী হোক-ইন্তাকিয়ার আশেপাশে তার সংবাদ পৌঁছে গেছে। তারপর যখন লোকেরা শুনতে পেল যে, সে ইন্তাকিয়ার নিকটে এসে পৌঁছেছে, তখন চারদিকে ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। রাতে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মুসাফিররা তাদের যাত্রা মুলতবী করে দিল।
একদিন ইন্তাকিয়ার তিন চারজন খ্রিস্টান অধিবাসী মুসলমান সালারের নিকট গিয়ে বলল, বেশ কিছুদিন যাবৎ এক বদরূহ বা ডাইনীর কথা শহরের ঘরে ঘরে আলোচিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে মানুষ শুনতে পেয়েছে, সে নাকি শহরের অতি নিকেট এসে পৌঁছেছে। ভয়ে এখন মানুষ সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে বেরোয় না। অনেকে সফরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
সেই প্রতিনিধি দলের বর্ষিয়ান লোকটি বলল, আমরা ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। আমরা জানি, জ্বীন, বদরূহ বা ডাইনীর সামনে মানুষ একেবারে দুর্বল। কোন মানুষ তার মুকাবিলা করতে পারে না। তবে মুসলমানদের কিছু আলেম আছেন যারা অলৌকিক শক্তি বলে তাদের বশে আনতে পারে। তাই আমরা আপনার শরণাপন্ন হলাম।
প্রতিনিধি দলের কথা শুনে সালার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর তার শির দুলে উঠল। বললেন, হ্যাঁ, তুমি সত্য বলেছো। ইসলামে এমন শক্তি রয়েছে যা জ্বীন, বদরূহ ও ডাইনীদের সহজে কাবু করতে পারে। আসল কথা হল, মুসলমানরা বিশ্বাস করে, যে মারা যায় সে আর কখনো ফিরে আসে না। আর ডাইনী নামে কোন বস্তু পৃথিবীতে নেই। ইসলাম গ্রহণ কর, তোমার মাঝেও ঐ শক্তির সৃষ্টি হবে। তুমিও তখন নির্ভয়ে দৃঢ়তার সাথে ঐ বদরূহ বা ডাইনীর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে পারবে, তুমি কে? কি তোমার পরিচয়?