রূতাসের চেহারা ভয়ে ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ হয়ে গেল। সে চিনে ফেলল, এ তো সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী। দাসী পরিবৃতা হয়ে চলাফেরা করত তাই অনেকেই তাকে চিনে।
রূতাসের কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময় ঝরে পড়ল। বলল, আপনি…..সম্রাজ্ঞী লীজা! আপনি এখানে….সম্রাট হিরাক্লিয়াস কি এখানেই কোথাও আছেন?
লীজার কণ্ঠ থেকে যেন সত্যই সম্রাজ্ঞীর সুর ফুটে উঠল। বলল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো? কোথায় যাচ্ছ?
রূতাস এ কথা বিশ্বাসই করতে পারছে না যে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী কোন জনমানবহীন প্রান্তরে পড়ে থাকতে পারে। তার মনে হল, হয়তো কোন জ্বীন বা প্রেতাত্মা সম্রাজ্ঞী লীজার আকৃতি ধারণ করে আছে। তাই তার ভয় ও ভীতি আরো বেড়ে গেল।
রূতাসের কণ্ঠে ভয়ার্ত আওয়াজ। বলল, না, না ….. আপনি হিরাক্লিয়াসের সাথে রোমে থাকার কথা। আপনি কার প্রেতাত্মা! আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আপনার সুখ-নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটালাম।
এই বলেই সে ভয় ও ভীতির প্রচণ্ডতায় পশ্চাৎদিকে না ফিরেই দূরে সরে যেতে লাগল।
লীজা তার কণ্ঠে গাম্ভীর্য টেনে এনে বলল, দাঁড়াও। যেয়ো না। তুমি তো রোমান বাহিনীর একজন সৈনিক। তোমার নাম কি?
রূতাস ধীর পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে এসে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, আমার নাম রূতাস। আমি রোমান বাহিনীর সালার ছিলাম। মুসলমানরা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আমি পালিয়ে এসেছি।….. আমি কি এখন যেতে পারি।
আন্তোনীস এবং ইউকেলিস গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে রূতাসের পশ্চাৎদিক থেকে এগিয়ে এল। উভয়ের হাতে খোলা তলোয়ার। তারা রাতাসের একেবারে নিকটে এগিয়ে এলে রূতাস অনুভব করল, তার পশ্চাৎদিক থেকে কেউ এগিয়ে আসছে। সে ঘুরে দেখেই মুহূর্তে দূরে সরে গেল। সে তার সালার আন্তোনীস এবং সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র ইউকেলিসকে চিনে ফেলল।
বিস্ময়ে জ্ঞানশূন্যের ন্যায় বলে উঠল, আমি এসব কী দেখছি!…. আপনারা সবাই এখানে কি করছেন?
আন্তোনীসের তরবারীর তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ রাতাসের হৃদপিণ্ড বরাবর চলে গেল। বলল, রূতাস! তুমি কি মনে করছে যে, আমি জানি না, তুমি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের গুপ্তচর বাহিনীর অফিসার। তুমি অস্বীকার করতে পারবে যে, তুমি আমাদের সন্ধানেই এদিকে এসেছে?
রূতাস বলল, আপনি কেমন সালার হলেন? আপনার তো একথাই জানা নেই যে, আমি তিন চার মাস যাবৎ রোমান বাহিনীতে নেই। আমি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পক্ষ থেকে এদিকে আসিনি। আমি মুসলমানদের কয়েদখানা থেকে পালিয়ে এসেছি।
মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল, আমি চরবৃত্তিতে হিমসে গিয়েছিলাম। আমার সাথে আরো দুজন ছিল। আমরা গ্রেফতার হয়ে গেলাম। আমার সাথী দুজন নিহত হয়েছে। আর আমি সুযোগ পেয়ে পালিয়ে এসেছি।
ইউকেলিসের অগ্নিকণ্ঠ ঝরে পড়ল। বলল, তাহলে এদিকে কিসের সন্ধানে এসেছো? এদিকে তো রোমান বাহিনী নেই!
লীজা বলল, তার চেহারার সজীবতা আর পোষাকের বাহার দেখ। যদি তিন চার মাস বন্দীই থাকতো তাহলে তো চেহারা থাকত বিধ্বস্ত আর কাপড় থাকত অপরিচ্ছন্ন, মলিন। সে তো আমাদেরকে ধোকা দিচ্ছে।
রূতাস তার কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল, হয়তো আপনার বিশ্বাস হবে না যে, মুসলমানরা বন্দীদের সাথে মেহমানের মত আচরণ করে।
আন্তোনীস বাম হাত দ্বারা তার জামার কলার চেপে ধরে তার কোমড় হাতড়ে তরবারীটি নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল, নিশ্চয় তারা মেহমানের মত আদর আপ্যায়ন করে পালিয়ে আসার সময় তারা তোমাকে এ তরবারীটিও দিয়ে দিয়েছে।
তারপর আরো হাতড়ে দেখতে লাগল, কোন খঞ্জর আছে কি না। কিন্তু খঞ্জর পেল না। তবে হাতে একটি শক্ত বস্তু অনুভব করল। সে তা টেনে বের করে চাঁদের রোশনীতে ঝলমল করছে দেখে লীজার হাতে দিল। তারপর বলল, এ ক্রুশ প্রমাণ করে যে, তুমি মিথ্যাবাদী। আর আমি এটাও জানি যে, এ ক্রুশটি কার?
এ ক্রুশটি মালে গণিমত হিসাবে সিপাহসালার আবু উবায়দার নিকট পৌঁছেছিল। নিহত এক রোমান অফিসারের নিকট তা থাকত। এখন তো চিন্তা করতে হবে, যদি তুমি মুসলমানদের কয়েদখানায় বন্দী থাকতে তাহলে কি তারা তোমাকে এই মূল্যবান বস্তুটি তোমার সাথে রাখতে দিত? তারপর আন্তোনীস বলল, আচ্ছা তুমি এখনো কেন মিথ্যা বলে যাচ্ছো? শোন, আমার নাম আন্তোনীস! সত্য কথা বল। অন্যথায় তোমার লাশ এ প্রান্তরে পড়ে থাকবে। পশু পক্ষীর জন্য তা মজাদার খাবার হবে।
রূতাস এবার সত্য কথা বলতে লাগল। আমি আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরছি। আমি শুনেছি, সম্রাট হিরাক্লিয়াস পিছু হটে গেছেন। কিন্তু আমি আর তার নিকট ফিরে যাব না। তবে কোথায় যাব তাও আমার জানা নেই। চরবৃত্তির জন্যই আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু বন্দী হওয়ার পর মুসলমানরা আমার থেকে আমার বাহিনীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছে। তারপর সে তার বন্দী হওয়া থেকে মুক্তি পর্যন্ত সব কাহিনী বলে দিল। শারীনার প্রসঙ্গও বাদ দিল না। কিভাবে শারীনা তাকে কয়েদখানা থেকে মেহমান খানায় থাকার ব্যবস্থা করল। কিভাবে ধোকায় ফেলে মদ পান করিয়ে তার থেকে রোমান বাহিনীর গোপন তথ্য জেনে নিয়েছে। সব কিছুই বলল। তারপর বলল, আমার মনে হয়, আমার তথ্য পেয়েই মুসলমানরা আমাদের বাহিনীকে সহজে পরাজিত করতে পেরেছে। হয়ত এ কারণেই মুসলমানদের সিপাহসালার আবু উবায়দা আমাকে এ কুশটি পুরস্কার দিয়েছেন।