মদীনায় ফিরে এসে হযরত উসমান (রা.) ও আরো অনেকের সাথে পরামর্শ করলেন। কিন্তু কেউ মিসর আক্রমণের পক্ষে মত দিলেন না। সবাই বললেন, এতো দূরে আরেকটি বিশাল যুদ্ধের সামর্থ কি এখন আমাদের আছে!
দূরদর্শী উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)। তিনি আমর ইবনে আস (রা.)-কে নিরাশ করলেন না। তার মনোবল ভেঙে দিলেন না। তাকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় খোঁজ খবর ও তথ্য সংগ্রহের পরামর্শ দিলেন। বিভিন্নভাবে উৎসাহও প্রদান করলেন। কথার এক ফাঁকে বললেন, আচ্ছা, আমর ইবনে আস! শুনলাম মিসরের খ্রিস্টানরা নাকি এক লোমহর্ষক রেওয়াজ পালন করে আসছে। তারা বিশ্বাস করে, নীল নদী মাঝে মধ্যে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে মিসরবাসীদের নিকট ভোগ চায়। সে ভোগ হল কুমারী নারী বলীদান। আর তখন মিসরের লোকেরা একজন কুমারী নারীকে অপরূপা সাজে সুসজ্জিত করে নীল নদীতে নিক্ষেপ করে। আর তারপরই নদীতে পানি-প্রবাহ শুরু হয়। তাদের এই রেওয়াজ এমন আকার ধারণ করেছে যে, এখন তারা প্রত্যেক বৎসরই একজন কুমারী নারীকে এভাবে নদী বক্ষে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। আর তারা এটা ধর্মীয় উৎসবের ন্যায় মহাসমারোহে পালন করে।
আমর ইবনে আস (রা.) হযরত উমর (রা.)-এর কথা স্বীকার করলেন। বললেন, মানুষ সত্য ধর্মচ্যুত হলে নানা কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ে। বাতিল ও অবাস্তব বিষয়কে আঁকড়ে ধরে আর সত্যকে অবজ্ঞার সাথে পরিহার করে। তবে আমার বিশ্বাস, মিসরীয়রা সত্যের সন্ধান পেলে সাথে সাথে তা গ্রহণ করবে। ইসলাম গ্রহণে তারা জড়তায় ভুগবে না। ফলে তাদের কুসংস্কার আর মিথ্যা রোসম-রেওয়াজ চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে যাবে।
***
আলেপ্পা নগরীর পতনের পরে সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) নগরীতে এলেন। খ্রিস্টান কবীলার সর্দারদের সাথে আলোচনা করলেন। সর্দাররা অকপটে স্বীকার করল যে, তারা মারাত্মক ভুল করেছে। সে ভুলের যথপোযুক্ত শাস্তিও তারা পেয়েছে। সর্দাররা বলল, দুই রোমান সালারের নেতৃত্বে তারা বিদ্রোহ করেছিল। তারাই তাদেরকে বিদোহে উস্কানী দিয়েছিল। ইতিপূর্বে আবু উবায়দা (রা.) শারীনার স্বামী হাদীদ ইবনে মুমিনের থেকে শুনেছে, রোমান সালার আন্তোনীস ও রূতাস খ্রিস্টান কবীলার লোকদের বিদ্রোহে উৎসাহিত করেছিল। হাদীদ আরো বলেছে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এক স্ত্রী ও তার এক যুবক পুত্রও পালিয়ে এসেছিল। তারাও এ বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল।
সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। পরক্ষণে উদ্বেলিত কণ্ঠে বললেন, রোমান সাম্রাজ্য ছিল এক বিশাল মহীরুহ। এখন তার নিঃশেষের সময় এসে গেছে। দেখ কিভাবে তার ডালপালাগুলো ভেঙে ভেঙে চারদিকে পড়ছে। এক রোমান সালার বিদ্রোহ করে চলে এসেছে। তার সাথে এসেছে সম্রাটের এক স্ত্রী ও তার পুত্র। তারা একটি নতুন সাম্রাজ্য গড়ার জন্য এসেছিল। তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। এভাবে রোম সাম্রাজ্যের সকল ডালপালা ভেঙে পড়বে আর পানির অভাবে তার শীকড় শুকিয়ে যাবে।
সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) কিছুদিন আলেপ্পা নগরীতে থাকার পর হিমসে চলে এলেন। তিনি শামের একেকটি অঞ্চল একেকজন সালারের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। তারা সেখানে প্রশাসন সুবিন্যস্ত করে সাজাচ্ছেন। জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। জিযিয়া সহ অন্যান্য কর আদায়ের সুব্যবস্থা করছেন। এভাবে দ্রুত শামের প্রশাসনিক কাঠামো সুশৃঙ্খল ও সুদৃঢ় ভিত্তি পায়।
আলেপ্পা ও ইন্তাকিয়ার মাঝে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মাইলের ব্যবধান। এ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাঝে মাঝে ঝোঁপঝাড় ঘন গাছগাছালী। মাঝে মাঝে বিস্তৃত উঁচু-নীচু টিলা। কোথাও খা খা মরুভূমি। পানি আর সবুজের কোন চিহ্ন সেখানে নেই। রোম সাগরের তীরে ইন্তাকিয়া শহর। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো এখানেই এসে নোঙর করে। মালামাল নামায়। আবার নতুন মাল বোঝাই করে বিভিন্ন বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। মিসরের ইস্কান্দারিয়া বন্দরের অনেক জাহাজ এখানে আসে। এখানের জাহাজও ইস্কন্দারিয়ায় যায়। আলেপ্পা আর ইন্তাকিয়ার মাঝের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন মুসলমানদের দখলে। এখানে দুচারটি ক্ষুদ্র কবিলা থাকলেও দূরে দূরে তাদের অবস্থান। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আলেপ্পা বিজয়ের কিছুদিন পরের ঘটনা। যারা আলেপ্পা থেকে ইন্তাকিয়ায় গিয়েছে বা ইন্তাকিয়া থেকে আলেপ্পায় এসেছে তারা বলেছে যে, শহরের বাইরে ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ে ভরা এলাকায় ডাইনী বদরূহ দিশেহারা হয়ে ঘুরছে। মাঝে মাঝে সে চিৎসার করে উঠে আর দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন বলে। লোকেরা তার আওয়াজ শুনে দ্রুত পালিয়ে যায়।
একদিন এক মুসাফির আলেপ্পা শহরে এসে এক সরাইখানায় উঠল। তার চেহারায় ভয়-ভীতি আর আতঙ্ক। সে স্পষ্টভাবে কথাও বলতে পারছে না। সরাইখানার সবাই বুঝল, লোকটি পথে ভয়ঙ্কর কিছু দেখেছে। তারা তাকে হিম্মৎ দিল। সান্ত্বনা দিল। অভয় দিল। তারপর লোকটি বলল, আমি আমার গ্রাম থেকে এক খচ্চরে চড়ে আলেপ্পায় আসছিলাম। এক ঝোঁপের পাশ দিয়ে আসার সময় একেবারে নিকট থেকে শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে, আমি তার খুন পান করব। সে আমার খুন ঝড়িয়েছে। তারপরই আমি এক ভয়ঙ্কর চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেলাম। সে চিৎকার নিঃসন্দেহে কোন মহিলার।