এই দুই যুবতীর একজনের নাম মারিয়া কিবতিয়া। তাঁকে রাসূল (সা.) স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা মিসরীদের সাথে ভাল আচরণ করবে। তোমাদের উপর তাদের দাবী আছে। তাদের সাথে তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কও রয়েছে।
আমর ইবনে আস (রা.) আরো বললেন, মিসরীরা খ্রিস্টান। কিন্তু তারা একটি ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আছে। রোমান সাম্রাজ্যে এ ধরনের অনেক খ্রিস্টান উপদল রয়েছে। এরা প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসও খ্রিস্টান। সে মিসরীয়দের ও অন্যান্য উপদলের ঘোর বিরোধী। সম্রাট হিরাক্লিয়াস বিভিন্ন দল উপদলের আলাদা বিভিন্ন আকীদা বিশ্বাসকে সমন্বয় করে একটি রাষ্ট্রীয় ধর্ম উদ্ভাবন করেছিল। সবাইকে সে ধর্ম মানতে বাধ্য করত। মিসরের রাজধানী ইস্কান্দারিয়ার প্রধান পুরোহিত কীরসকে এ কাজের জন্য দায়িত্ব দেয়া হল। তাকে অধিকার প্রদান করা হল, সে যে কোন প্রকারে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও খ্রিস্টানদেরকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম মানতে বাধ্য করবে।
সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ভয়ে সকল দল উপদলের হৃদয় চুপসে গেল। তাদের আর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে মিসরীয়রা হিরাক্লিয়াসের চাপিয়ে দেয়া খ্রিস্ট ধর্মকে মেনে নিল না। কীরস তাদের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করল। হিংস্রতায় কীরস পশুকেও ছাড়িয়ে গেল। প্রায় দশ বৎসর যাবৎ মিসরীয়রা ধর্মের নামে নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করছে। তাদের কোন আশ্রয়দাতা ছিল না। সমবেদনা জানানোর মতও তাদের কেউ ছিল না।
আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, এই নিপীড়িত নির্যাতিত মিসরবাসীদের রক্ষার দায়িত্ব কাদের? নিশ্চয় আমাদের।
তারপর আমর ইবনে আস (রা.) মিসরের অপরিসীম ধন-সম্পদ, মহামূল্যবান পাথর, মূল্যবান ধাতুর অসংখ্য খনি ইত্যাদির সবিস্তারিত আলোচনা করলেন। বললেন, আল্লাহ্র জমীন থেকে উৎসারিত এ সকল সম্পদ রোম সম্রাটের প্রাসাদে চলে যায়। অথচ সাধারণ জনগণ ক্ষুৎপিপাসায় হাড্ডিসার হয়ে ধুকে ধুকে মরছে। শ্রমজীবীরা সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সামান্য রুটি রুজীর ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের শ্রমের সকল ফসল চলে যায় শাহী প্রাসাদে।
আমর ইবনে আস (রা.)-এর কণ্ঠ এবার আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল। বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আমার হৃদয় বলছে, নীল নদীর দেশ মিসর আমাদের ডাকছে। আমিরুল মুমিনীন! আমি আপনাকে আমার এক ব্যক্তিগত ঘটনা শুনাতে চাই। যে বিষয়টিকে আমি আল্লাহর ইঙ্গিত মনে করি
তখন ছিল রোমানদের রাজত্ব। মিসরের শাসক ছিল তারাই। আমি ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে বাইতুল মুকাদ্দাস গেলাম। একদিন কাফেলার উট চড়ানোর দায়িত্ব আমার উপর এসে পড়ল। আমি উট নিয়ে দূরের এক চারণভূমিতে গেলাম। আমি অত্যন্ত সংক্ষেপে ঘটনাটি আপনাকে বলছি।
আমি উটগুলোকে চারণভূমিতে ছেড়ে দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এক গাছের ছায়ায় বসে ছিলাম। তখন পাহাড়ের গা বেয়ে এক খ্রিস্টান নেমে এল। পিপাসায় প্রায় অর্ধমৃত। আমি তাকে পানি দিলাম। সে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেল। তার নাম ছিল শাম্মাস। পানি পানের পর সে অদূরে এক গাছের ছায়ায় গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পরে রইল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, এক বিষাক্ত সাপ তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমার হাতে ছিল তীর ধনুক। আমি সাথে সাথে তীর ছুঁড়ে মারলাম। সাপটি মরে গেল। ঘুম ভেঙ্গে শাম্মাস সব শুনে হতবাক। বিস্ময়াবিভূত। সে আমাকে তখন ছাড়ল না। সাথে করে মিসরে নিয়ে গেল। সে ছিল মিসরের রাজধানী ইস্কান্দারিয়ার অধিবাসী। রাজ পরিবারের সাথে তার গভীর সখ্যতা ছিল। তখন মিসরে এক রাজকীয় আনন্দানুষ্ঠান ছিল। শাম্মাস আমাকে সে অনুষ্ঠানে নিয়ে গেল। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে আমি দেখলাম, এক পাদ্রীর হাতে একটি স্বর্ণের বলয়। সে চোখ বন্ধ করে তা উপরে ছুঁড়ে মারছে। বলয়টি ঘুরতে ঘুরতে কারো মাথায়, পিঠে বা অন্য কোন অঙ্গে পড়ছে।
আমি শাম্মাসকে এর রহস্য জিজ্ঞেস করলাম। শাম্মাস বলল, এ ধরনের উৎসবে ঐ পাদ্রি চোখ বন্ধ করে স্বর্ণের এ বলয়টি নিক্ষেপ করে। নিক্ষিপ্ত বলয়টি যার বাহুতে গিয়ে পড়বে সেই পরবর্তীতে মিসরের বাদশাহ হবে।
আরো কয়েকবার বলয়টি নিক্ষেপ করার পর হঠাৎ তা আমার বাহুতে এসে পড়ল। সাথে সাথে সবাই হর্ষধ্বনী দিয়ে উঠল। অনেকে হাত তালি দিল। রাজপরিবারের লোকেরা আমার পরিচয় জানতে চাইলে শাম্মাস বলল, এর নাম আমর ইবনে আস। আরবের মক্কা নগরীর অধিবাসী। সাথে সাথে চারদিক থেকে ঠাট্টা মশকরা আর বিদ্রুপের আওয়াজ ভেসে আসল। বাহ্ বাহ্ দেখ, এ বামন নাকি মিসরের বাদশাহ হবে! ভারি চমৎকার কথা! সেদিন এ ধরনের অনেক বিদ্রূপ আমি শুনেছিলাম।
এ ঘটনা শোনানোর পর আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার মাথায় কখনো এ ধরনের চিন্তা আসেনি যে, সেই বলয়টির কারণে আমি একদিন না একদিন মিসরের বাদশাহ হব। রাজত্ব তো আল্লাহর। তবে আমার ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা আমি মিসরে আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করব। আমি এখন আপনার অনুমতির অপেক্ষায় আছি।
হযরত উমর (রা.) অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মনোযোগ সহকারে আমর ইবনে আস (রা.)-এর কথাগুলো শুনলেন। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন যে, মিসর বিজয়ের জন্য আমর ইবনে আস (রা.)-এর নেতৃত্বে একদল মুজাহিদ পাঠাতে হবে। কিন্তু তখনই কিছু বললেন না।