উমর (রা.) বললেন, হে ইবনে আস! শুধু আতাবুনের প্রতিই তোমার দৃষ্টি নিবন্ধ করো না। তুমি কি দেখছো না, আমি কিসরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। শামেও রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। যদি আমরা আবার সুদূর মিসরে আরেকটি যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলি তাহলে হয়তো ইরান ও রোমে আমাদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।
আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর সাথে হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-এর আলোচনা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বরং তিনি মিসরের ইতিহাস তার সামনে তুলে ধরলেন। কুরআনের যে সব আয়াতে মিসরের আলোচনা এসেছে তা পাঠ করে শুনালেন। বনী ইসরাইল আর মূসা (আ.)-এর কথাও আলোচনা করলেন। মূসা (আ.) আর ফেরআউনেরও আলোচনা করলেন। কিভাবে আল্লাহ মূসা (আ.)-এর জন্য সাগরের মাঝে পথ করে দিলেন আর ফেরআউন তাতে নিমজ্জিত হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হল। হযরত ইউসুফ (আ.)-এর কথাও আলোচনা করলেন।
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) নিরবে হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-এর কথা শুনে যেতে লাগলেন। এসব কথা উমর (রা.)-এর অজানা নয়। কিন্তু তিনি হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-কে থামিয়ে দেননি। তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন, কোন নিয়তে, কোন উদ্দেশ্যে আমর ইবনে আস (রা.) মিসর আক্রমণ করতে চাচ্ছেন। তিনি কি নিজের জন্য একটি রাজত্ব কায়েম করতে চাচ্ছেন, না এ কারণে মিসর আক্রমণ করতে চাচ্ছেন যে, মিসর ছাড়া ইসলামী খেলাফতের পরিধি অপূর্ণ থেকে যায়!
তিনি আরব বিশেষভাবে হিজাজের অধিবাসী ও মিসরের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথাও আলোচনা করলেন। তিনি আরো বললেন, হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) আরবদের পূর্বপুরুষ। আর তার মাতা হাজেরা ছিলেন মিসরের অধিবাসী। হযরত ইসমাঈল (আ.) জ্বরহুম গোত্রের এক সতীসাধ্বী মেয়েকে বিয়ে করেন। তার বারটি সন্তান হয়। এ বারজনই আরবদের পূর্ব পুরুষ। সুতরাং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর নানার বাড়ি মিশর হওয়ার কারণে মিসরের সাথে আরবদের নাড়ীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
তিনি বললেন, মিসরকে নিয়ে রোম ও পারস্য সম্রাট যুদ্ধে নিপতিত হল। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ৬১৬ খ্রিস্টাব্দে মিসরে ইরানীরা রোমানদের পরাজিত করল এবং নয় বৎসর তারা শাসন করল।
রোমে তখন হিরাক্লিয়াসের উত্থান হল। সে ইরানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল এবং মিসর ও শামকে ইরানীদের থেকে মুক্ত করে নিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে পূর্বেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, রোমানরা শীঘ্রই ইরানীদের উপর বিজয় লাভ করবে। প্রিয় নবীর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
ষষ্ঠ হিরজীতে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিয়ে বিভিন্ন দেশে দূত প্রেরণ করেন। ইরান সম্রাট, রোম সম্রাট, হীরার শাসক, গাসাসানের শাসকের সাথে মিসরের শাসক মুকাউঁকিসের নিকটও ইসলাম গ্রহণের আহবানসহ পত্র প্রেরণ করেন। হাতিব (রা.) এ পত্র নিয়ে মিসরে গিয়েছিলেন।
মিসরের বাদশাহ মুকাউঁকিস রাসূলের পত্র অত্যন্ত আদবের সাথে গ্রহণ করেছিলেন ও মনোযোগের সাথে পাঠ করেছিলেন। রাতে বাদশাহ মুকাউঁকিস হযরত হাতিব (রা.)-কে একাকী নির্জনে ডাকলেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে তাঁকে বসালেন। বললেন, আমাকে আপনার রাসূল সম্পর্কে কিছু বলুন। হাতিব (রা.) রাসূল (সা.)-এর গুণাবলী বর্ণনা করলেন এবং বিশ্বাসযোগ্য কিছু প্রমাণও উপস্থাপন করলেন।
সবকিছু শোনার পর মুকাউঁকিস বললেন, আমি জানি, একজন নবীর আগমনের সময় হয়ে গেছে। তবে আমার ধারণা ছিল তিনি শামে আত্মপ্রকাশ করবেন। কারণ ইতিপূর্বে প্রায় সব নবীই শামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এখন দেখছি এ নবী এক ভয়াবহ মরুর বুকে জন্মলাভ করেছেন। আমি যদি এ নবীকে গ্রহণ করে নেইও তবে মিসরীরা কিন্তু তাকে গ্রহণ করে নিবে না। শোন, এ কিন্তু তোমার ও আমার মাঝে একান্ত আলাপচারিতা। কেউ যেন তা জানতে না পারে। তবে আমার বিশ্বাস, এ দেশও তোমাদের নবীর পদানত হবে। তোমাদের নবীর অনুসারীরা মিসরে পদার্পণ করবেন। মিসর পদানত করবেন। তুমি কিন্তু মিসরবাসী কারো নিকট এ সম্পর্কে কোন আলোচনা করবে না।
সেদিন রাতে আর মুকাউঁকিসের চোখে ঘুম আসেনি। দুগ্ধফেনলিভ সুকোমল বিছানায় শুতেই তার মাথায় বিভিন্ন চিন্তা এসে ভীড় করল। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো তাকে অস্থির করে তুলল। প্রতিশ্রত নবী সম্পর্কিত আলোচনাগুলো একে একে তার চোখের সামনে পরিস্ফুট হয়ে উঠতে লাগল।
পরদিন সকালে মিসরের বাদশাহ মুকাউঁকিস আবার হাতিব (রা.)-কে ডেকে পাঠালেন। একেবারে পাশে বসালেন এবং আরবী ভাষায় একটি চিঠি লিখে তার হাতে দিলেন। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন?
আব্দুল্লার পুত্র মুহাম্মদের প্রতি মিসরের বাদশাহ মুকাউঁকিসের সালাম। আমি আপনার পত্র পাঠ করেছি। আপনি যা কিছু তাতে লিখেছেন এবং যার দাওয়াত দিয়েছেন তা বুঝেছি। আমি জানতাম, একজন নবী সমাগত। তবে আমার ধারণা ছিল, সে নবী শামে আত্মপ্রকাশ করবেন। আমি আপনার দূতের যথাযোগ্য ইহতেরাম করেছি। আর আপনার খেদমতে দুই মিসরী যুবতী পাঠালাম। তারা মিসরের উঁচু খান্দানের মেয়ে, আর আপনার আরোহণের জন্য একটি উন্নত জাতের খচ্চর উপহার পাঠালাম।