রোজীর মা ও শারীনা যখন ঘরে বসে কথা বলছে ঠিক তখন তারা বাইরে রোজীর চিৎকার ধ্বনি শুনতে পেল। চিৎকার করে রোজী বলছে, ইউকেলিস ও তার মাকে হিরাক্লিয়াসই হত্যা করিয়েছে। আমি হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করতে যাচ্ছি। তার পরই রোজীর দৌড়ে যাওয়ার পদধ্বনি শোনা গেল। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কাল বিলম্ব না করে রোজীর মাও পিছনে পিছনে ছুটল। শারীনাও বেরিয়ে এল। দেখল, রোজী শহরের সদর দরজার দিকে ছুটে চলছে। তার পিছু পিছু তার মা চিৎকার করে বলছে, তাকে ধর, তাকে ধর, যেতে দিয়ো না ….. দিয়ো না……।
শহরের অবস্থা তখন এমন, একজনের দিকে অন্যের ফিরে তাকাবার সুযোগ নেই। সবাই স্বজনদের লাশ বয়ে চলেছে। কেউ কেউ রক্তাক্ত জখমীকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মৃত্যুর হাহাকার। স্বজন হারানোর হৃদয় বিদারক কান্না। তাই কেউ আর রোজী ও তার মায়ের দিকে ফিরে তাকাল না।
***
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর নির্দেশ সবাই মেনে নিল যে, সামনে আর অগ্রসর নয়। এবার বিজিত অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে মনযোগী হওয়া জরুরী। কিন্তু একজন সালারের উত্তপ্ত রক্ত এখনো টগবগ করছে। তিনি আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ হৃষ্টচিত্তে মেনে নিতে পারলেন না।
সিপাহ সালার হযরত আবু উবায়দা (রা.) যখন আলেপ্পায় পৌঁছেছিলেন এবং সকল মুজাহিদকে একত্রিত করে আমিরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.)-এর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে এক সংক্ষিপ্ত ও মূল্যবান ভাষণ দিয়েছিলেন, তখন সে সালার সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি অন্যত্র ছিলেন। পরে তিনি আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ শুনেও চুপ থাকলেন না। তিনি এ নির্দেশের ব্যাপারে একমত হতে পারলেন না। তিনি হলেন হযরত আমর ইবনে আস (রা.)। তার দ্বিমতের কথা সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.)-এর কানে পৌঁছল। তিনি দুঃখ পেলেন। এর কিছুদিন পর আমর ইবনে আস (রা.)-এর সাথে দেখা হলে প্রথমে তিনি বললেন, হে আমর ইবনে আস! এমন দুঃখজনক আচরণ কেন করছো? এতে তো মুজাহিদদের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বিভেদ সৃষ্টি হয়।
আমর ইবনে আস (রা.)-এর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠ, বললেন, রোমানদের পশ্চাদ্ভাবন করা উচিৎ ছিল। আমি রোমানদের পিছু পিছু মিশর পর্যন্ত পৌঁছতে চাই। রোমানরা এখন ছিন্নভিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে ভেড়া বকরীর ন্যায় দিগ্বিদিক ছুটে পালাচ্ছে। এ সময় যদি আমরা তাদের পশ্চাদ্বাবন করে মিশরে গিয়ে পৌঁছি তাহলে মিশর খুব সহজে আমাদের দখলে চলে আসবে।
সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) বললেন, ইবনে আস! তোমার কথা শুনে আমি দারুণ বিস্মিত, অত্যন্ত আশ্চাৰিত। এতো তাড়াতাড়ি তুমি ভুলে গেলে যে, বিভিন্ন গোত্রের খ্রিস্টানরা শুধুমাত্র এ কারণে শহরে শহরে বিদ্রোহ করছে যে, সেখানে মুজাহিদের সংখ্যা অনেক কম। তারা প্রশাসন সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। এটা তো আল্লাহর অশেষ রহমত যে, আমরা অতি সহজে বিদ্রোহ দমন করতে পেরেছি। এবার একটু চিন্তা করে দেখ, আমাদের বাহিনী এসব শহর ছেড়ে সামনে অগ্রসর হলে এই সুযোগে তারা কি বিদ্রোহ করবে না? নিশ্চয় করবে।
আমর ইবনে আস (রা.) কোন সাধারণ সালার ছিলেন না। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ, চৌকস ও হুঁশিয়ার। মিসরকে ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করা ছিল তার এক ইস্পাত কঠিন শপথ। মনে হত আল্লাহ্ যেন তাকে মিসর বিজয়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তাই তাকে এই আকাঙ্ক্ষা ও চেতনা দান করেছিলেন।
***
৩. বিকালের কোমল বায়ু
বিকালের কোমল বায়ুর গায়ে হালকা দুরন্তপনা। পত্রপল্লবে মৃদু ঝাঁপটা দিয়ে দিয়ে অনন্তে মিশে যাচ্ছে। সূর্যের আলোর প্রখরতা কমে এসেছে। সবার মনে প্রশান্ত প্রশান্ত ভাব। কিন্তু আমর ইবনে আস (রা.) এর মাথায় দারুণ চিন্তা। মিশর বিজয়ের চিন্তায় তিনি বিভোর। বাইতুল মুকাদ্দাসে এসেছেন খলীফা উমর (রা.)। একটি বিষয় নিয়ে সরাসরি তাঁর সাথে আলোচনা করতে এলেন হযরত আমর ইবনে আস (রা.)। বললেন, আমি আপনার সাথে একটি জরুরী বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছি।
উমর (রা.) বললেন, কিসের আলোচনা, বলুন।
হযরত আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহর শপথ করে বলছি। আপনি রোমান সালার আতরাবুনকে এমনিভাবে চিনেন যেমনিভাবে আপনি আপনার ডান হাতকে চিনেন। আমি কখনো একথা বিশ্বাস করব না যে, আমাদের খলীফা এ আত্মঅহমিকায় বিভোর হয়ে আছেন আর ভাবছেন, রোমান সালার আত্রাবুন ভয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস ছেড়ে মিশরে চলে গেছে। আমাদের প্রত্যয় ও বিশ্বাস, আমরা স্বপ্নে বিভোর থাকি না। আর নিজেকে নিজে প্রবঞ্চিত করা মুজাহিদদের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
হযরত উমর (রা.) হযরত আমর ইবনে আস (রা.)-কে থামিয়ে দিয়ে বললেন, হে ইবনে আস! তুমি যে কথার ভূমিকা রাখছো সরাসরি তা বলে ফেলাইতো ভাল। আমি তোমার কথা মনযোগ সহকারে শুনছি।
হযরত আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি বলতে চাচ্ছি, আরাবুনের পশ্চাদ্ভাবন করা উচিত।
উমর (রা.) বললেন, ইবনে আস! আমরা যে বিশাল বিসৃত অঞ্চল পদানত করেছি, তাকি তুমি যথেষ্ট মনে করছো না?
হযরত আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, আপনার নির্দেশ শিরধার্য। কিন্তু আমরা যদি আতরাবুনকে কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগ দেই তাহলে নিঃসন্দেহে একদিন সে ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ বাহিনী তৈরী করে আবার আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। হিরাক্লিয়াস আর আতরাবুন এক ইবলিসের দুই নাম। আতরাবুনের মাথায় এতো কূট-কৌশল ও বুদ্ধি রয়েছে যে, সে ফিলিস্তিন ও আরবের খ্রিস্টানদের বিদ্রোহের জন্য উসকে দিতে পারে। মিসরে সে এ জন্যই গিয়েছে। তাই আমাদের উচিত, তাকে স্থির হয়ে কোথাও দাঁড়াতে না দেয়া। আপনার অনুমতি হলে আমি মিসর আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত আছি।