আহত ও জখমীদের তুলে তুলে শহরে আনা হচ্ছে। আহতদের সেবার জন্য একটি ফৌজী চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে সবার চিকিৎসা চলছে। মুসলমান, খ্রিস্টান সবার জন্য তার দরজা উন্মুক্ত। মুসলমান নারীরা আহতদের ক্ষতস্থানে মলম পট্টি লাগিয়ে দিচ্ছে। সেবা-শুশ্রূষা করছে। শারীনা একাজে নিয়োজিত ছিল। অত্যন্ত যত্নের সাথে দীর্ঘক্ষণ এ কাজ করছে।
শহরের এক গলি দিয়ে যাওয়ার সময় শারীনা কিছু সমবেত মহিলাকে আলোচনা করতে শুনল। তারা বলছে, ঐ বাড়িতে এক রোমান সালারের স্ত্রীর লাশ পড়ে আছে। শারীনার অনুসন্ধিৎসু মনে দোলা লাগল। সে হাঁটতে হাঁটতে সেই বাড়িতে উপস্থিত হল। গিয়ে দেখল, এখনো দুচারজন মহিলা লাশটি দেখছে।
শারীনা লাশ দেখে একেবারে হতবাক। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে কাঁপতে লাগল। আরে! এতো লীজার লাশ! সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী লীজা। সে এখানে এলো কিভাবে। তাকে হত্যা করল কে? মুসলমানরা তো কোন মহিলাকে হত্যা করে না, বরং কোন মহিলার দিকে তাকানোও তাদের নিকট মহাপাপ।
শারীনা যখন শুনেছিল যে, দুজন রোমান সালার মারা গিয়েছে। সে তখন তাদের লাশ দেখেছিল। আন্তোনীসকে সে চিনত। আন্তোনীসের লাশ দেখে সে দারুণ বিস্মিত হয়েছিল। তারপর রাতাসের লাশ দেখে তো সে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। সে চিন্তা করেছিল, হয়তো সম্রাট হিরাক্লিয়াস তাদের দুজনকে আলেপ্পা নগরীতে বিদ্রোহ সৃষ্টি করার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু হিরাক্লিয়াস তার স্ত্রীকে কেন পাঠাবে? চিন্তার যোগসূত্র সব ছিন্নভিন্ন করে যাচ্ছে। কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না।
যে দুচারজন মহিলা লীজার লাশের পাশে ছিল তারা চলে গেল। শারীনা একাকী লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। এক আকাশ চিন্তা তার মাথায়। সবকিছুই ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
হঠাৎ শারীনা একটি মিহি সুরেলা নারী কণ্ঠ শুনতে পেল। না…..না তা হতে পারে না। সবকিছু মিথ্যা। মিথ্যা। মিথ্যা।
শারীনা সচকিত হয়ে ফিরে তাকাল, দেখল, সেই খুবসুরত রূপসী যুবতীটি যাকে সে ইউকেলিসের লাশের সামনে পেয়েছিল। ইউকেলিস তাকে আদর করে রোজী নামে ডাকত। শারীনা তাকে ইউকেলিসের লাশের পাশে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে চলে এসেছিল। তাকে এতটুকুও জিজ্ঞেস করনি যে, সে কে? কি তার পরিচয়? এখন হয়তো সে কারো মুখে শুনেছে যে ইউকেলিসের মায়ের লাশ অমুক স্থানে পরে আছে। তাই সে এখানে ছুটে এসেছে। সে এসে লীজার মাথা ধরে এমনভাবে নাড়া দিচ্ছে যেন কোন ঘুমন্ত মানুষকে জাগ্রত করছে। সে বলছে, মা! আপনি মরতে পারেন না। মা! আপনি বলতেন, আমাকে ইউকেলিসের বধূ বানাবেন। উঠুন মা! উঠুন! ইউকেলিসের নিকট চলুন! সে তো আপনার অপেক্ষা করছে।
শারীনার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। হৃদয় চিরে কান্নার গমক বেরিয়ে আসতে লাগল। সে বুঝতে পারল, এই যুবতী ইউকেলিসের বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারেনি। সে ভারসাম্য হারিয়ে আধা পাগলিনী। শারীনা তার কাঁধে হাত রেখে তাকে পাশে দাঁড় করাল। তারপর বলল, রোজী! আমি তাকে তুলে নিব। সে তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সে তোমার কি হয়?
রোজী উত্তরে বলল, সে ইউকেলিসের মা! আমার কিছু হয় না। তবে আমার সবকিছুই ইনি। আমাকে ইউকেলিসের পাশে দেখে তিনি খুব আনন্দিত ও বিমুগ্ধ হতেন। বলতেন, আমি আমার পুত্রের জন্য তোমার মত কনেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ খুঁজছি।
এ মেয়ের দুঃখে শারীনার হৃদয় হাহাকার করে উঠে। সে ভেবেই পাচ্ছে না যে, সে কিভাবে তাকে বুঝাবে যে, ইউকেলিস মারা গেছে আর তার মাও মারা গেছে। এরা দুনিয়াতে আর ফিরে আসবে না। শারীনা তার হাত ধরে তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছে। কথার মাঝে মাঝে তাকে শান্ত্বনা দিচ্ছে, তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যে একজন বয়সী মহিলা ছুটে এসে উপস্থিত হল। সেও যুবতী মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মহিলাটিকে দেখে মনে হল সে রোজীর মা। মহিলা রোজীকে মমতার সাথে বলছে, রোজী! চল! বাড়িতে ফিরে যাই।
রোজী পরিষ্কার কণ্ঠে বলছে, মা! তুমি ফিরে যাও! আমি ইউকেলিসকে ডেকে আনছি। সে তার মাকে ঘুম থেকে তুলে ঘরে নিয়ে যাবে।
শারীনা রোজীর মাকে ইশারা করল, যেন তিনি এখন রোজীকে মুক্ত থাকতে দেন। শারীনা রোজীর মাকে একটি কামরায় নিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, আপনার মেয়ের কি হয়েছে?
রোজীর মা বলল, ইউকেলিসের সাথে রোজীর প্রেম ছিল। তারা একে অপরকে হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছিল। ইউকেলিস বলেছিল, তার পিতা সম্রাট হিরাক্লিয়াস। কিন্তু তার এক ভাই নাম কুসতুমীন-সে তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আন্তোনীস তাকে রক্ষা করেছে। ফলে আন্তোনীসের সাথে সে ও তার মা পালিয়ে এসেছি। ইউকেলিস রোজীকে একথাও বলেছিল, সে প্রকৃতপক্ষে আন্তোনীসের সন্তান। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নয়।
রোজীর মুখে শোনা সব কথা তার মা শারীনাকে বললো। শারীনা এ কথা শুনে বিস্মিত হল না যে ইউকেলিসের মা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী হলেও ইউকেলিস সম্রাটের পুত্র নয়। বরং আন্তোনীসের পুত্র। কারণ এ ধরনের ঘটনা রাজা-বাদশাদের হেরেমে প্রচুর ঘটে থাকে।
তারপর রোজীর মা বলল, আন্তোনীস মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেই একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিল। সে তার স্বপ্নের সাম্রাজ্যকে ঈসা মাসীহের সাম্রাজ্য বলত।