আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। নিকট ও দূর ভবিষ্যতে কি ঘটবে বা ঘটতে পারে তা তিনি অনুমান করতে পারতেন এবং সেভাবেই পদক্ষেপ নিতেন।
মদীনায় বসে তিনি দেখলেন, মুজাহিদ বাহিনী সুবিস্তৃত এলাকা পদানত করে ফেলেছে। শাম থেকে পালিয়ে গেছে সম্রাট হিরাক্লিয়াস। রোমানদের জুলুম অত্যাচারে নিষ্পেষিত শামের অধিবাসীরা স্বাধীনতা লাভ করেছে। সুতরাং তাদের মাঝে এখন সুশাসন কায়েম করতে হবে। ইসলামের সুমহান আদর্শ তাদের মাঝে বিকশিত করতে হবে। তা না করে যদি মুজাহিদ বাহিনী সামনেই অগ্রসর হতে থাকে তাহলে প্রচণ্ড আশংকা হচ্ছে যে, রোমান গুপ্তচরদের উস্কানীতে শামের লোকেরা চারদিক থেকে বিদ্রোহ করবে। রোমান বাহিনী আবার রুখে দাঁড়াবে। তাহলে মুজাহিদদের এ অভাবনীয় বিজয় পরাজয়েও রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। তাই তিনি সিপাহ সালারের নিকট নির্দেশ পাঠালেন। আর সামনে অগ্রসর নয়। এবার বিজিত এলাকায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার পালা। শাসন ব্যবস্থা দৃঢ় ও মজবুত করা এখন বিজিতদের প্রধান দায়িত্ব।
শাম পদানত করার পর সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) নামাযের পর মুজাহিদদের লক্ষ্য করে যে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়েছেন তা আজো ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে। যার প্রতিটি ছত্র আল্লাহর রাহের মুজাহিদদের চিরদিন অমূল্য পাথেয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেছিলেন?
আল্লাহ্ কুরআনে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমরা সে প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। আরেকটি বাতিল শক্তিকে ধূলিস্মাৎ করে ইসলামী খিলাফতের সাফল্য বিস্তৃত করেছি। আসলে ইসলামী খিলাফতের কোন সীমানা নেই। আমরা আমাদের রাজত্ব কায়েমের জন্য নয় বরং আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করছি। এ ভূপৃষ্ঠ আল্লাহর। এ ভূপৃষ্ঠে আল্লাহর বিধানই চলবে। শহীদরা আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আল্লাহর রাহে জীবন কুরবান করে দিয়েছে। আল্লাহ্ শহীদদেরকে নিজের নিকট আশ্রয় দেন। তবে যারা জিহাদ করে দুই হাত, পা বা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে তাদের কুরবানী ও আত্মেত্যাগের কথা স্মরণ কর। তারা সারাটি জীবন বিকলাঙ্গ প্রতিবন্ধী হয়ে থাকবে। তবে সে কারো মুখাপেক্ষী নয়। আল্লাহই তার সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা ও পরিজনের রিযিকের জিম্মা নিয়ে নিয়েছেন। রক্ত দিয়ে তারা যে জমিন আযাদ করেছে সে জমিন তাদের জন্য ফসল উৎপন্ন করবে। নিজেকে কখনো তুচ্ছ ভেবো না। তোমাদের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে। তোমরা তো প্রত্যহ কুরআন পড়। তোমরা কি একথা পড়নি বা শোননি যে, আল্লাহ্ তোমাদের শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে ঘোষণা করেছেন! আর তোমাদের গর্বের বিষয় হল, তিনি তোমাদেরকে বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য এবং মানুষকে অন্যায় অমঙ্গল থেকে রক্ষার জন্য নির্বাচিত করেছেন। তোমরা নিপীড়িত মানুষকে যালিম বাদশাহদের কবল থেকে উদ্ধার করবে। মানুষকে মিথ্যার অন্ধকার থেকে সত্যের আলো উদ্ভাসিত পথে নিয়ে আসবে। সুতরাং তোমরা নিজেদেরকে নিঃসঙ্গ বন্ধুহীন মনে করবে না। আল্লাহ্ সর্বদা আমাদের সাথে আছেন।
***
আলেপ্পা শহরের পতন ঘটেছে। মুজাহিদরা শহরে প্রবেশ করেছে ও করছে। শহরের চতুর্পার্শ্বে খ্রিস্টান যোদ্ধাদের লাশ ছড়িয়ে আছে। বহু দূর পর্যন্ত তাদের লাশ দেখা যাচ্ছে। মহিলারা শিশু কিশোররা শহরের বাইরে চলে এসেছে। সবার চোখে স্বজন হারানোর অশ্রু। দুঃখ বেদনার ছাপ। তাদের আহাজারি আর আর্তচিৎকারে হৃদয় কেঁপে উঠে। তারা স্বজনদের লাশ খুঁজছে। এক মহিলা চিৎকার করে বলছে, হায়! কার জন্য তোমরা যুদ্ধ করলে? কার জন্য তোমরা প্রাণ দিলে? রোমান দুই সালারই আমাদের সর্বনাশ করল। ওই দুই সালারই আমদের ধ্বংস করল।
মহিলার এই কথা এক কান দুকান হয়ে অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই তা বলাবলি করতে লাগল।
অপর এক মহিলা বলল, আরে শুধু দুই সালারই নয় তাদের সাথে ছিল এক ডাইনী। খুব সুরত ডাইনী। সে মহিলাদের যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করত।
আরেক মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, ডাইনী মহিলা এখন কোথায় লুকিয়েছে?
অন্য এক মহিলার রোষ কষায়িত কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, তাকে জীবিত পেলে কেটে দুটুকরো করব।
এক মহিলা বলল, ঐ ডাইনী মহিলার স্বামী মারা গেছে। তার ছেলের কোন সন্ধান নেই।
আরেকজন বলল, আরে! আরেকজন সালার কি যেন নাম সেও মারা গেছে। আমি তার লাশ দেখেছি।
কয়েকজন মহিলার সমবেত ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, আরে ঐ ডাইনীকে পেলে সাত-পাঁচ ভেবনা। খঞ্জরের আঘাতে শেষ করে দাও। তাদের কারণেই আমাদের এই দশা, এই সর্বনাশ।
ধীরে ধীরে অনেক মহিলা এসে সেখানে সমবেত হয়েছে। আরেক মহিলা বলল, আরে! তোমরা সেই ডাইনীর কথা বলছো! সে তো ঐ দ্বিতীয় সালারের বাড়িতে মরে পড়ে আছে। বেশ কিছু মহিলা এবার সে দিকে ছুটল। তারা দেখল, উঠানে লীজার লাশ পড়ে আছে। রক্তে রক্তে একাকার। রক্তের ধারা নীচু জায়গা দিয়ে এদিক সেদিক চলে গেছে। মহিলারা নাকে কাপড় দিয়ে ঘৃণা আর ক্ষোভ প্রকাশ করতে করতে চলে এল। কেউ বলল, লাশ টেনে নিয়ে বাইরে ফেলে এস। আরেকজন বলল, তা করে আর লাভ কি, এখানেই পড়ে থাকুক। পঁচে গলে নিঃশেষ হয়ে যাক। বাড়িটি বিরাণ হয়ে থাক।