উন্মাদিনীর ন্যায় রোজী আহত ও নিহতদের মাঝে ঘুরে ফিরছে। ছুটে ছুটে গিয়ে আহত আর নিহতদের চেহারা দেখছে। মাঝে মাঝে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে। আবার উঠে এদিক সেদিক ছুটছে। অবশেষে সে শারীনা ও ইউকেলিসের নিকট পৌঁছল। ইউকেলিসকে দেখে উন্মাদিনীর ন্যায় তাকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখে মুখে হাত বুলাতে লাগল। সে নির্বাক।
শারীনা ইউকেলিসের এক হাত ধরে বলল, ইউকেলিস! উঠার চেষ্টা কর। আমরা দুজন তোমাকে তুলে নিতে পারব। তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।
রোজীর কাঁপা কাপ কণ্ঠ। বলল, ইউকেলিস! উঠ।
ইউকেলিস রোজীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,রোজী! আমি তোমার অপেক্ষায় এখনো বেঁচে আছি। আমার মাকে বলবে……. এরপর আর কিছু বলতে পারল না। তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এল। ওষ্ঠাধর মৃদু কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে গেল।
রোজী চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ইউকেলিসের লাশ জড়িয়ে ধরে পাথর হয়ে রইল। শারীনার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বেদনা-বিধূর শারীনা অশ্রু মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে গেল। রোজীকে সে জিজ্ঞেসও করল না, তুমি কে হে যুবতী! ইউকেলিসকে তুমি কিভাবে চিন?
***
দু অপরাজেয় শক্তি। দু পরাশক্তি। রোম সাম্রাজ্য আর ইরান সাম্রাজ্য। এই দুই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একই সময়ে জিহাদ করছে আরবের মুসলিম মুজাহিদরা। মাত্র এক যুগ পূর্বে যাদের পৃথিবীর কেউ চিনত না। ধিক্কার আর লাঞ্ছনা ছিল যাদের কপালের লিখন। আত্মকলহ আর রক্তারক্তি ছিল যাদের নেশা। হাতে তৈরী মূর্তিপূজায় যারা বুঁদ হয়ে থাকত তারা আজ বিশ্বের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। প্রায় অর্ধেক পৃথিবী তাদের পদতলে।
ইরানের সম্রাটকে মানুষ খোদার পুত্র মনে করে। যার অস্ত্রশস্ত্র আর ধন-সম্পদের কোন পরিমাপ নেই। কিন্তু আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র রাসূলের অনুসারীগণ যখন কালিমার দাওয়াত নিয়ে ছড়িয়ে পড়লেন, তখন তথাকথিত আল্লাহ্র পুত্র ইরান সম্রাট ইয়াযদগির্দ রাজধানী মাদায়েনে সমস্ত ধন-সম্পদ, হিরা-জওহার ফেলে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। গোটা ইরান সাম্রাজ্য মুসলমানরা দখল করে নিল। দুনিয়ার বুক থেকে পারস্য সাম্রাজ্যের চিত্র চিরদিনের জন্য মুছে গেল। পালিয়ে ইয়াযদগির্দ তুর্কিস্থানে আশ্রয় গ্রহণ করল। সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার আশায় সুযোগের সন্ধানে রইল। তার আশা ছিল, একদিন না একদিন ইরানের লোকেরা বিদ্রোহ করবে আর সেই সুযোগে সে তার সাম্রাজ্য ফিরে পাবে। মুসলমানদের নিরস্ত্র করে তবে ক্ষান্ত হবে।
বৎসরের পর বৎসর দীর্ঘ অপেক্ষার পরে হযরত ওসমান (রা.)-এর সময় সে সুযোগ পেল। খোরাসানে বিদ্রোহ হল। ইয়াযদগির্দ এ সুযোগকে সুবর্ণ মনে করে তুর্কিস্থান থেকে মারিতে পৌঁছল। বিভিন্ন কবিলার সর্দারদের সাথে যোগাযোগ করে বিদ্রোহের আগুনে তৈল ঢালল। শুরু হল প্রচণ্ড বিদ্রোহ। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী দ্রুত তা দমন করে ফেলল।
ইয়াযদগির্দের অনুসারীরা পালিয়ে গেল। ইয়াযদগির্দ আবার তুর্কিস্তানে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু ভাগ্যের লিখন কে খণ্ডাতে পারে। সে আর ফিরে যেতে পারল না। সিপাহ সালার সংবাদ পাওয়ার পর ইয়াযদগির্দকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন।
ইয়াযদগির্দ পালিয়ে ফিরতে লাগল। মুজাহিদ বাহিনী তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল। একদিন সে এক খরস্রোতা নদীর তীরে এক পানচাক্কির কামরায় গিয়ে লুকাল। পানচাক্কির মালিক ইয়াযদগির্দকে চিনতো না কিন্তু তার বাদশাহী পোশাক ও ভয় ভয় ভাব দেখে তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গেল যে, সে ইয়াযদগির্দ। পানচাক্কির মালিক তার কামরার দরজা বন্ধ করে মারি শহরে গিয়ে শাসককে বলল, ইয়াযদগির্দ তার কামরায় লুকিয়ে আছে। শাসক সাথে সাথে এক সালারকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ইয়াযদগির্দকে হত্যা করে তার শির নিয়ে এস। পানচাক্কির মালিক এ নির্দেশ শুনে আর দেরি করেনি, সাথে সাথে দৌড়ে চলে এসে নিজ হাতেই ইয়াযদগির্দকে হত্যা করে তার শির কেটে ফেলল। সালার এলে তাকে ইয়াযদগির্দ এর শির দিয়ে দিল এবং তার লাশ নদীর অথৈ পানিতে ভাসিয়ে দিল। এভাবেই পারস্য সাম্রাজ্যের অপরাজেয় শক্তির কর্ণধার সম্রাট ইয়াযদগির্দ পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিল। অহংকারের চির পরাজয় ঘটল।
***
এদিকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়ার্সের অবস্থাও অত্যন্ত করুণ। যাকে শক্তি দেবতা মনে করা হয়, যার ভয়ে পৃথিবী থর থর করে কাঁপে। সে আজ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে ফিরছে। কিন্তু কোথাও আশ্রয় পাচ্ছে না। আলেপ্পা নগরী শামের শেষ কেল্লা। তাও মুজাহিদ বাহিনী দখল করে নিয়েছে।
মুজাহিদ বাহিনী যখন শামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে তখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস শামের নিরাপদ শহর ইন্তাকিয়ায় আশ্রয় নিল। সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। ভয়ে হিরাক্লিয়াস সেখান থেকে পালিয়ে রাহা শহরে আশ্রয় নেয়। মুজাহিদ বাহিনী এবার রাহা শহরে পৌঁছে গেল। সে এবার শাম থেকে বহু দূরে দুর্গময় শহর কনস্টান্টিনোপলে আশ্রয় নিল। চিরদিনের জন্য শাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। এভাবে পরাজয় ঘটল আরেক অহংকারী বাদশাহর।
সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ভাগ্য প্রসন্ন যে, মুজাহিদ বাহিনী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল হঠাৎ তাদের গতি থামিয়ে দেয়া হল। যদি তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকত তাহলে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত।