খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) যুদ্ধ বন্ধ করে দিলেন। নির্দেশ দিলেন, যারা আত্মসমর্পণ করেছে তারা যেন তাদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে শহরের উন্মুক্ত প্রান্তরে শহরবাসীদের সাথে সমবেত হয়। নির্দেশ মোতাবেক খ্রিস্টান যোদ্ধারা অস্ত্র ফেলে নতশিরে শহরের উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে সমবেত হল। কিছুক্ষণ পর খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) শহরের প্রধান দরজা দিয়ে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করলেন। এটা ছিল শামের সর্বশেষ কেল্লা। সেটিও আজ মুজাহিদ বাহিনীর পদানত হল। গোটা শাম এখন মুসলমানদের দখলে। যে উন্মুক্ত প্রান্তরে শহরের লোকেরা একত্রিত হয়েছে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সে প্রান্তরে গেলেন। চারদিকে দেখে কি যেন বুঝলেন। তারপর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলেন :
আরব খ্রিস্টান ভাইয়েরা! আমরা যুদ্ধ করে এ শহর পদলিত করেছি। আমাদের অনেকে নিহত হয়েছে। অনেকে আহত হয়েছে। বহু বন্ধুকে হারানোর ব্যথা আমাদের মনে। তোমাদের আঘাতে তারা শহীদ হয়েছে। তাই তোমাদের সাথে ব্যবহার করা উচিত অন্যরকম। কিন্তু আমি সে পথে যাব না। আমি আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.)-এর প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হব। আমাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী তোমাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলব। আর তারপরও আমাদের অধিকার আছে, আমরা তোমাদের থেকে ক্ষতি পূরণ দাবী করব।
কিন্তু বনু তাগলিব রণক্ষেত্রে যখন অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তখন আমীরুল মুমিনীন নির্দেশ দিয়েছিলেন, কাউকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে না। তার বিনিময়ে তাদের থেকে জিযিয়া-কর নেয়া হবে। এই জিযিয়া কর প্রত্যেকের সামর্থানুযায়ী হবে। তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রোমানদের সাথে যোগ দিয়েছিলে। সেজন্য তোমাদের কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা তোমাদের কোন শাস্তি দেব না। শহরের কোন বাড়িতে লুট তরাজ হয়েছে? কোন মুসলমান কি কারো ঘরে প্রবেশ করেছে?
সমবেত জনতার সাঝ থেকে উত্তর এল, না, না, সিপাহ সালার! গোটা শহরের কোথাও সামান্য দুর্ঘটনাও ঘটেনি।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) বললেন, আমরা তোমাদের মান-ইজ্জত, ধন-সম্পদের হিফাজতকারী। কিন্তু এরপর যদি কেউ বিন্দু পরিমাণ গাদ্দারী করো তাহলে আর ক্ষমা নয়। তাকে হত্যা করা হবে।
উল্লেখ্য যে, আলেপ্পা বাসীদের হৃদয় জুড়ে যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল তা নিমিষে দূর হয়ে গেল এবং খালিদ (রা.)-এর আবেগময় হৃদয়স্পর্শী অগ্নিঝরা বক্তৃতায় তখনই অনেকে ইসলাম গ্রহণ করল।
***
সূর্য অস্তমিত হওয়ার এখনো অনেক সময় বাকি। মুজাহিদরা তাদের আহত সাথীদের ও শহীদদের লাশ রণাঙ্গন থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম নারীরা রণাঙ্গন জুড়ে আহতদের পানি পান করাচ্ছে। যারা হাঁটতে পারছে তাদের ধরে ধরে যেখানে চিকিৎসা করা হচ্ছে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রচুর আহত মুজাহিদ। একের পর এককে ব্যাণ্ডেজ করা হচ্ছে। মুসলিম নারীরা তাদের সেবা-শুশ্রূষা করছে।
রণাঙ্গনের অবস্থা আরো করুণ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের মাঝ থেকে ক্ষীণ করুণ কণ্ঠ ভেসে আসছে। পানি, পানি, এক ঘোট পানি, কখনো শোনা যাচ্ছে আহতের আর্তনাদ। নারীরা পানির পাত্র নিয়ে রণাঙ্গনে আহতদের পানি পান করাচ্ছে। এদিকে সেদিকে ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ সে এক আতহকে দেখে থমকে দাঁড়াল। বিস্মিত হতবাক হয়ে তার পাশে বসে পড়ল। এ এক আহত যুবক। চেহারায় কোন আঘাত না লাগলেও সারা শরীরে তার ক্ষতের দাগ। রক্তে রক্তে একেবারে একাকার হয়ে গেছে গোটা দেহ। উৎলে উৎলে যেন শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।
শারীনার কণ্ঠে সন্দেহ। বলল, তুমি কি ইউকেলিস? সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র এখানে কেন?
আহত যুবকের ওষ্ঠাধর কেঁপে উঠল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, শারীনা! আমি ইউকেলিস। আমি তোমাকে দেখে বিস্মিয়াভিভূত। তুমি এখানে এলে কিভাবে?
ইউকেলিসের কণ্ঠ অস্পষ্ট। স্পষ্ট করে বলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। জীবনীশক্তি তার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
শারীনা বলল, ইউকেলিস! চুপ থাক। এখন জীবন কাহিনী বলার বা শোনার সময় নয়। এই নাও পানি। পান কর। আমি তোমাকে তুলে এক্ষুণি মলম পট্টি লাগানোর ব্যবস্থা করব। আমার সাথে চল।
ইউকেলিস বলল, না, শারীনা! আমার জীবন প্রদীপ এখনই নিভে যাবে। একটু পরই আমি অনন্তলোকে হারিয়ে যাব। আমি এখনো কিভাবে জীবিত আছি তা ভেবে পাচ্ছি না। এখানেই আমাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দাও।
ইউকেলিস কাঁপা কাপ হাতে শারীনার হাত ধরল। কি জানি বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না।
শারীনা ইউকেলিসকে বলল, আমি কয়েকজন মুজাহিদকে ডেকে আনছি। তারা তোমাকে শহরে নিয়ে যাবে। ইউকেলিস শারীনার হাত আরো শক্ত করে ধরল। বারবার মাথা দুলিয়ে বলছে, না, না, শারীনা! আমি মলম পট্টি লাগাব না। তাতে আমার কোন উপকার হবে না। আমি এখন জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।
দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের মাঝে আরেকজন যুবতী ইউকেলিসকে খুঁজে ফিরছে। সে রোজী। মহিলাদের জন্য বাইরে বেরুনো নিষেধ থাকা সত্ত্বেও রোজী লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু ঘর থেকেই নয়, শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে। এবং রণাঙ্গনে পৌঁছে তন্ন তন্ন করে ইউকেলিসকে খুঁজে ফিরছে। হয়তো কেউ তাকে বলেছে, ইউকেলিস আহত হয়ে পড়ে আছে বা নিহত হয়েছে।