এবার খ্রিস্টান যোদ্ধাদের যুদ্ধ পদ্ধতি ভিন্ন ধরনের। তারা ডানে বামে হামলা না করে সোজা চলে গেল। মুজাহিদরা তা প্রতিহত করতে প্রস্তুত হল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল। এ যুদ্ধে মুজাহিদরাও ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। তারা খ্রিস্টান যোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করছে কিন্তু আগে বেড়ে আক্রমণ করছে না। ক্রমেই তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। খ্রিস্টান যোদ্ধারা বুঝতে পারেনি, খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) কত দূরদর্শী, কতো বিজ্ঞ সিপাহসালার। মুজাহিদ বাহিনী যখন ক্রমে পিছু হঠে যাচ্ছে তখন খ্রিস্টান যোদ্ধারা মনে করেছে, মুসলমানরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের উপর আক্রমণ করতে করতে শহর থেকে দূরে চলে এসেছে। আন্তোনীস ও রূতাসও মুজাহিদ বাহিনীর যুদ্ধ-কৌশল বুঝতে পারেনি। তারা ধারণাও করতে পারেনি, তারা কেল্লা থেকে এতো দূরে চলে এসেছে যেখান থেকে শবেষ্টনি ভেদ করে ফিরে যাওয়া কঠিন।
শহরের উভয় পার্শ্বের খ্রিস্টান যোদ্ধারা যুদ্ধ করতে করতে যখন শহর থেকে অনেক দূরে চলে এল, ঠিক তখন শহরের আশে পাশে পাহাড় ও টিলার পশ্চাতে লুকায়িত একদল অশ্বারোহী বেরিয়ে বিদ্যুৎ বেগে শহরের দিকে ছুটে গেল। তারা শহর ও খ্রিস্টান যোদ্ধাদের মাঝামাঝি অবস্থান নিল। এরা ঐ অশ্বারোহী বাহিনী যারা অবরোধ তুলে চলে গিয়েছিল এবং পাহাড় টিলা ও ঝোঁপ ঝড়ের আড়ালে আত্মগোপন করেছিল। এদিকে আন্তোনীস ও শহরের নেতৃস্থানীয় লোকেরা প্রবঞ্চনায় পরে ভেবেছিল যে, মুসলমানরা অবরোধ তুলে নিয়েছে। অশ্বারোহী এই বাহিনী এতদিন পর্যন্ত সিপাহ সালারের ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ছিল। আজ ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তারা নিখুঁতভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে।
শহরের দিকে ছুটে আসা এই অশ্বারোহী মুজাহিদদের কিছু অংশ সোজা শহরে প্রবেশ করল। অন্যরা খ্রিস্টান যোদ্ধাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এদিকে মুজাহিদ বাহিনীও থমকে দাঁড়াল। এবার তারা পিছু না হটে সামনে অগ্রসর হতে লাগল। খ্রিস্টান যোদ্ধারা চারদিক থেকে মুজাহিদ বাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেল। খ্রিস্টান যোদ্ধাদের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চারদিক থেকে বাঁচাও বাঁচাও রব উঠল। কিন্তু সবদিক অন্ধকার। মুজাহিদদের তলোয়ারের আঘাতে খ্রিস্টান যোদ্ধারা লুটিয়ে পড়তে লাগল। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। খ্রিস্টান যোদ্ধাদের লাশ আর লাশ।
যে সব মুজাহিদ শহরে প্রবেশ করেছিল তারা ছোটখাট বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু তা মুহূর্ত কালের জন্য। মুজাহিদ বাহিনী প্রায় যুদ্ধ ছাড়াই শহর দখল করে নিল। তারপর ঘোষণা করে দিল, পুরুষরা যেন ঘরের বাইরে চলে আসে। মেয়েরা ঘরে থাকবে। যদি কোন পুরুষকে ঘরে লুকায়িত পাওয়া যায় তবে তাকে হত্যা করা হবে। মহিলাদের কোন ভয় নেই। কেউ তাদের দিকে অশুভ দৃষ্টিতেও তাকানোর সাহস পাবে না। কোন বৃদ্ধ, বালক ও অসুস্থের উপর অত্যাচার করা হবে না। বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ লোকেরাও ঘরের বাইরে আসবে না।
মুজাহিদদের এই ঘোষণা খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করতে পারল না। তারা স্ত্রীদের, যুবতী কন্যাদের ঘরের গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখে দুরু দুরু হৃদয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। মহিলারা ভয়ে আতঙ্কে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে রইল। তারা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে থরথর করে কাঁপছে। কেউ জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দেয়ারও সাহস পাচ্ছে না। যদি বিজয়ী এই বাহিনী রোমান, ইরান বা অন্য কোন অমুসলিম জাতি হত, তাহলে এতক্ষণে লুটতরাজ শুরু হয়ে যেত। ঘরে ঘরে ঢুকে নির্বিচারে নির্দয়ভাবে হত্যালীলা চালাত। যুবতী নারীদের কৌমার্য নিয়ে উল্লাস করা হত। কোন যুবতী তাদের লোলুপতা থেকে রেহাই পেত না। কিন্তু মুজাহিদ বাহিনী কারো বাড়িতে ঢুকে উঁকি পর্যন্ত দেয়নি।
শহরের সকল মানুষ এক উন্মুক্ত প্রান্তরে সমবেত হল। এদিকে শহরের বাইরে খ্রিস্টান যোদ্ধারা একের পর এক ধরাশায়ী হয়ে চলছে। তারা সিপাহ সালার খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর পাতানো ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে।
ইউকেলিস তার একশত জানবাজ যোদ্ধা নিয়ে মুজাহিদ বাহিনীর সিপাহ সালারকে খুঁজে ফিরছে। চোখে তার শাহীনের দৃষ্টি। সে জানে না, মুসলমানদের সিপাহ সালার বাদশাহ হয় না, যে রণক্ষেত্র থেকে দূরে অবস্থান করে যুদ্ধ পরিচালনা করে। যুদ্ধ চলাকালে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এক স্থানে স্থির রইলেন না। তার সাথে থাকে রক্ষীবাহিনী। ইউকেলিস তাকে খুঁজতে খুঁজতে তার সঙ্গী যোদ্ধাদের নিয়ে মুজাহিদ বাহিনীর আবেষ্টনীতে চলে এল। তারা একে একে আহত হয়ে ঘোড়া থেকে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ঘোড়ার পায়ে পদদলিত ও পিষ্ট হতে লাগল।
কে একজন চিৎকার করে বলে উঠল, রোমান সালার দুজন নিহত হয়ে গেছে। একে একে কয়েকজনে এ আওয়াজ দিল। মুহূর্তে গোটা রণাঙ্গনে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল। সাথে সাথে খ্রিস্টান যোদ্ধারা নিরাশার অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে লাগল। যেন তারা আলো থেকে হঠাৎ নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেছে। তারা তলোয়ার, বর্শা ও তীর-ধনুক ফেলে দিল। চিৎকার করে বলতে লাগল, আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা শান্তি চাই। যারা ঘোড়ার উপর সওয়ার ছিল, তারা ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। সবাই আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র ফেলে দিল।