আন্তোনীস ও রূতাসকে না জানিয়ে ইউকেলিস এক দুর্ধর্ষ জানবাজ অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তুলছিল। এ বাহিনীর সবাই অসম সাহসী, বীর বিক্রম। তারা সিদ্ধান্ত করেছে, তারা মুসলমানদের সিপাহ সালারের উপর বিদ্যুৎ বেগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকে জীবিত বা মৃত শহরে তুলে নিয়ে আসবে। তারা এ সিদ্ধান্তও করেছে যে, তারা অন্য কোথাও যুদ্ধ করবে না। শুধু সেখানেই যুদ্ধ করবে যেখানে সিপাহসালার অবস্থান করছে।
যুদ্ধের আর একদিন একরাত বাকি। ইউকেলিস তার মায়ের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে, আমি একটি দুর্ধর্ষ জানবাজ বাহিনী তৈরী করেছি। যে বাহিনীর কথা আন্তোনীস বা রূতাস কেউ জানে না। আমার এ বাহিনী মুসলমানদের সিপাহসালারকে জীবিত বা মৃত তুলে আনবে। সে তার মাকে বলেছে, সে এখন তার সেই বিশেষ বাহিনীর নিকট যাচ্ছে। যুদ্ধে বিজয়ের পর ফিরে আসব। মায়ের নিকট দুআ নিয়ে সে চলে গেল।
আন্তোনীস দারুণ ব্যস্ত। কাজের যেন শেষ নেই। চিন্তার যেন সীমানা নেই। কখনো সে কেল্লার উঁচু পাঁচিলের উপর গিয়ে উঠে। তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারদিক দেখে। তারপর ছুটে এসে কবিলার সর্দারদের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং অবস্থার পর্যালোচনা করে। যুদ্ধের চিন্তায় যেন সে পাগলপারা হয়ে গেছে।
***
দ্বিপ্রহর। আকাশে মেঘলা মেঘলা ভাব। গোটা প্রকৃতি মেঘমেদুর। এ সময়ে রূতাসকে তার খুব দরকার। আন্তোনীস কাউকে না পাঠিয়ে নিজেই তার তালাশে বেরিয়ে পড়ল। তার ধারণা, রূতাস কেল্লার পাঁচিলের কোথাও আছে। কিন্তু না। তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। সবশেষে সে রাতাসের বাড়িতে গেল। রূতাস একাই এ বাড়িতে থাকে। তাই আন্তোনীস ডাকাডাকি না করে সোজা ভিতরে চলে গেল।
উঠানে পৌঁছে রূতাসকে ডাক দিল। এক কামরা থেকে রাতাসের আওয়াজ শুনতে পেল। সে বলছে, জ্বী! আমি কাপড় পরিবর্তন করে আসছি। আন্তোনীস ভাবল, সে তো একা থাকে। তাই তার কামরার দিকে গেল। দরজা বন্ধ। দরজার একটি কপাটে হাত রাখতেই তা খুলে গেল। তারপর আন্তোনীস কামরায় যা দেখল তাতে তার মাথার রক্ত টগবগ করে উঠল। দেখল, কামরার বিছানা থেকে লীজা উঠে যাচ্ছে। প্রায় বিবস্ত্রা। কাপড় টানতে টানতে সে দ্রুত আড়ালে চলে গেল। রূতাসকেও সে বিবস্ত্র দেখতে পেল। আন্তোনীসের মস্তিষ্কে লেলিহান আগুন। সবকিছু সে মুহূর্তে ভুলে গেল। সাথে সাথে তলোয়ার কোষমুক্ত করে চিৎকার করে রূতাসকে লক্ষ্য করে বলল, হারামজাদা! তলোয়ার নিয়ে উঠানে চলে আয়। যে বেঁচে থাকবে সেই লীজাকে পাবে।
সাথে সাথে রূতাস চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে উন্মুক্ত তরবারী হাতে উঠানে লাফিয়ে পড়ল। আন্তোনীস আর রূতাস। উভয়ের হাতে ঝকঝকে তরবারী। তারা একে অপরের রক্ত পিপাসু। উভয়ে যেন ক্ষুধার্ত শার্দুল। বাড়ির উঠানে তরবারী নিয়ে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তরবারীর আঘাতে আঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরে পরতে লাগল। ইতিমধ্যে লীজা কাপড় পরে দৌড়ে উঠানে এল। দেখল, উভয়ের চোখে আগুনের গোলক। আঘাতের পর আঘাত হানছে একে অপরকে। মুহূর্তে লীজা দৌড়ে উভয়ের মাঝে এসে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে একে অপরের উপর আবারো আঘাত করে বসেছে। কিন্তু সে আঘাত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল না করে লীজার শরীরে লেগেছে। দুদিক থেকে দুই তরবারী লীজার পেটে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে গেল। উভয়ে তলোয়ার বের করে আনার পূর্বেই চিৎকার করে লীজা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। উভয়ে লীজার দিকে তাকাল। তারপর আবার প্রতিপক্ষের দিকে দৃষ্টি দিল। আন্তোনীস একটু পিছিয়ে এল। সে আবার রূতাসের উপর আক্রমণ করতে প্রস্তুত হচ্ছে।
রূতাস তার তরবারী জোড়ে উঠানোর এক কোণে নিক্ষেপ করল। সশব্দে তরবারীটি গিয়ে মাটিতে পড়ল। রূতাস চিৎকার করে বলল, আন্তোনীস! সাবধান! এক নারীকে নিয়ে আমরা আমাদের কর্তব্যের কথা ভুলে গেছি। আমরা কি ঈসা মাসীহ এর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা করিনি? আমাকে যদি মারতে হয় মেরে ফেল। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞার কথা ভুললে চলবে না। যে মারা গেছে সে এক বদকার নারী। এ নারীর কারণে আমাদের একে অপরের দুশমন হওয়া। অনুচিত।
আন্তোনীস থমকে দাঁড়াল। চমকে উঠল তার স্নায়ু। হ্যাঁ তাইতো! আন্তোনীস তার তরবারী কোষাবদ্ধ করে ফেলল। উঠানে পড়ে থাকা রূতাসের তরবারীটি তুলে তার হাতে দিল। বলল, যা ঘটেছে তা ভুলে যাও। আমরা বিজয় লাভ করতে পারলে নারীর অভাব হবে কি!
ইউকেলিস তার দুর্ধর্ষ জানবাজ বাহিনীর নিকট চলে গেছে। সে তার মাকে বলে গেছে, আক্রমণের পর বিজয়ী বেশেই সে ফিরে আসবে। কিন্তু তাকে এ সংবাদ দেয়ার কেউ ছিল না যে, তার মা রূতাসের বাড়ির উঠানে মরে পরে আছে। এদিকে আন্তোনীস ও রূতাস পূর্বের মত একজোট হয়ে গেছে। যেন তাদের মাঝে কখনো কোন দ্বন্দ্ব হয়নি।
***
এখনো প্রভাতের বিমল আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েনি। উদ্ভাসিত হয়ে উঠেনি পৃথিবী। চারদিকে আবছায়া। ঠিক তখন শহরের চারদিকের চারটি দরজা খুলে গেল। দরজা দিয়ে অসংখ্য অগণিত যোদ্ধা তীব্র গতিতে বেরুতে লাগল। এ চারটি দরজা ছাড়া পঞ্চম আরেকটি দরজা খুলে গেল। সে দরজা দিয়ে ইউকেলিস তার দুর্ধর্ষ একশত অশ্বারোহী যোদ্ধাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এ দরজা ইউকেলিসের নির্দেশে খোলা হয়েছে। আন্তোনীস শুধুমাত্র চারটি দরজা খোলার নির্দেশ দিয়েছিল আর বলেছিল, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যেন দরজা বন্ধ করা না হয়।