–মনযূর আহমাদ
১০.০৬.২০০৪ইং
.
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আন্তোনীস স্বপ্ন জগতের এক রঙ্গিন পৃথিবী রচনা করে এগিয়ে চলছে। সে তার মনযিল নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। এগিয়ে চলছে। সফলতা আর ব্যর্থতা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু এখন তার মনে কোন দ্বিধা নেই। কোন সঙ্কা নেই। সে যেন এক নিরাপদ গন্তব্যের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। কোন্ কবিলার কোন সর্দারের নিকট আশ্রয় নিবে তাও সে ঠিক করে নিয়েছে।
অন্যদিকে রূতাস দিক লক্ষ্যহীন ভাবে ঘুরে ফিরছে। যেন ভবঘুরে। তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রোমান সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবে না। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মুখোমুখি সে আর গিয়ে দাঁড়াবে না। কিন্তু কি করবে? কোথায় যাবে? কার নিকট আশ্রয় নিবে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো সে স্থির করতে পারেনি। একেক বার একেক কথা ভাবে আবার তা মুলতবী রেখে অন্য ভাবনায় ডুবে যায়। প্রায় দিকভ্রান্ত উন্মাদের মত পথ চলছে। চলতে চলতে দিবস সমাপ্তির পর রাত এগিয়ে এল। কোলাহলময় পৃথিবী অন্ধকারে হারিয়ে গেল। রূতাস এক নির্জন স্থানে শুয়ে দিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। পরদিন। সকালে আলোর বন্যায় পৃথিবী ঝলমল করে উঠল। আবার শুরু হল রূতাসের যাত্রা।
চলতে চলতে বার বার সে তার পকেট থেকে বের করে স্বর্ণের তৈরী ঈসা (আ.)-এর মূর্তিটি দেখছে। গভীর ভক্তিভরে ছলছল নেত্রে তাকিয়ে রয়েছে। যেন মূর্তিটি তার পথ নির্দেশ করছে। দীর্ঘ চিন্তার পর একটি আশ্রয় স্থান সে মনোনীত করল। সে এক খ্রিস্টান কবিলার মাঝে আশ্রয় নিবে। হিমসে থাকাকালে শারীনা প্রত্যেক দিন তার সাথে এসে সাক্ষাৎ করত। তার নিকট থেকেই সে প্রত্যেক দিনের সংবাদ পেত। শারীনা তাকে শুনিয়েছিল, আরব কবিলাগুলোর যে খ্রিস্টানরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে সাহায্য করার জন্য এসেছিল তারা সবাই তিক্ত-রিক্ত ও বিরূপ মনোভাব নিয়ে ফিরে চলে গেছে।
এ কথা ভাবতে ভাবতে সে আবার উদাস হয়ে যায়। আবার দিশেহারা হয়ে যায়। ভাবে, যদি আরব কবিলার খ্রিস্টানরা তাকে আশ্রয় না দেয়। যদি তারা তাকে তাড়িয়ে দেয়। তাহলে সে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিবে!
একবার সিদ্ধান্ত করে ফেলল, না, পথে পথে না ঘুরে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বাহিনীতেই ফিরে যাই। সাথে সাথে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু ক্ষণকাল যেতে না যেতেই সে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল। সে যেন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সম্রাট তাকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করছে, রূতাস! তুমি কোথায় গিয়ে পালিয়েছিলে? হিরাক্লিয়াসের ডাগর রক্ত চক্ষু, ক্রোধে লাল চেহারা, রুক্ষ্ম কণ্ঠস্বর যেন ভেসে এল। জল্লাদ! এই নরাধমকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে নিয়ে যাও। এ বেঈমান গাদ্দারের মৃত্যুদণ্ডই উত্তম পুরস্কার। জল্লাদ যেন তাকে হিড়হিড় করে সম্রাটের সম্মুখ থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
রূতাস চমকে উঠে। না, সম্রাটের কাছে আর যাব না। আবার ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নেয়।
দ্বিপ্রহর গড়িয়ে যাবার পর এক খুবসুরত সবুজ শ্যামল স্থানে পৌঁছল। তার পাশ দিয়ে একটি উজ্জ্বল নদী কুল কুল রবে বয়ে চলছে। ছায়া নিবিড় কাকলি মুখর স্থান দেখে বিশ্রামের জন্য ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। ঘাসের উপর গা এলিয়ে দিয়ে কোথায় যাবে ভাবছে। এমনি ভাবনার মাঝে সে গভীর ঘুমে হারিয়ে যায়।
অনেক সময় পর তার ঘুম ভাঙে। চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আকাশে চাঁদ উঠে এসেছে। ভাবল, বহু ঘুমিয়েছি। রাতটা বেশ ভাল কেটেছে। শীতল আবহাওয়ার ছড়াছড়ি। যাত্রা শুরু করলেই ভাল হবে। সকালের মধ্যেই বহুদূর চলে যাওয়া যাবে। ঘোড়ায় আরোহণ করে সে তার অজানা মনযিলের পথে রওয়া হল। এদিকে আন্তোনীস ও লীজা ইউকেলিসকে তাদের শোয়ার জায়গায় নিয়ে গেল। ইউকেলিসের মন এখন শান্ত। লীজা তাকে আদর-স্নেহে আপুত করে তুলে। তার কাছে সে নিজেকে ছোট্ট শিশুর মত ভাবছে। তিনজনই শুয়ে পড়ল। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তারা একটি ঘোড়ার আগমনের পদধ্বনি শুনতে পেল। দূর থেকে ধ্বনিটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসছে। সাথে সাথে গানের আওয়াজ শোনা গেল। রোমান ভাষায় গানটি রচিত। তারা সতর্ক ও উৎকর্ণ হয়ে উঠল। লীজা ফিসফিসিয়ে বলল, কেউ হয়তো আমাদের পশ্চাদ্ভাবন করছে!
আন্তোনীস বলল, মনে হচ্ছে একজন অশ্বারোহী আসছে। পশ্চাদ্বাবন করলে কয়েকজন অশ্বারোহী আসত। মনে হচ্ছে সে কোন মুসাফির অথবা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা কোন রোমান সৈন্য।
আন্তোনীস বলল, লীজা! তুমি এখানেই শুয়ে থাক। আমি আর ইউকেলিস লুকিয়ে যাই। দেখি, লোকটি কে? যদি মন্দ কিছু মনে হয় তাহলে পশ্চাৎদিক থেকে আক্রমণ করে তাকে শেষ করে দিব।
আন্তোনীস ও ইউকেলিস দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। একটি ছোট্ট ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। অশ্বারোহী সে স্থানটি অতিক্রম করার সময় তার দৃষ্টি শায়িত লীজার উপর পড়ল। সে অশ্বের গতি থামিয়ে দিল এবং আস্তে আস্তে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল। ঘোড়াটি পশ্চাতে রেখে লীজার দিকে অগ্রসর হল।
এখনো সে বুঝতে পারেনি যে, শায়িত ছায়ামূর্তিটি একজন নারী। রূতাসের এই দীর্ঘ সফরে এই প্রথম সে মানুষের মুখোমুখি হচ্ছে। নিকটবর্তী হয়ে বুঝতে পারল, শুয়ে থাকা লোকটি নারী। দাঁড়ান অবস্থায়ই সে একটু ঝুঁকল। লীজা উঠে বসল। পরে দাঁড়িয়ে গেল।