এদিকে শহরের নারীরা তাদের সন্তান, ভাই, পিতা ও স্বামীদের তালাশে পাগল পারা হয়ে গেল। যারা যুদ্ধ করে ফিরে এসেছে তারা তাদের উপর যেন উপচে পড়ল। সবার চোখে অশ্রু। মুখে আহাজারী আর বিলাপ।
তাদের মাঝে লীজাও বিদ্যমান। ইউকেলিস, ইউকেলিস বলে চিৎকার করে সে ইউকেলিসকে খুঁজছে। কিন্তু ইউকেলিসকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। লীজা দৌড়ে কেল্লার পাঁচিলের উপর উঠল। দেখল, দূরে ইউকেলিস রূতাসের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৌড়ে গিয়ে ইউকেলিসকে ঝাঁপটে ধরল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল। ইউকেলিস বলল, আম্মা! আপনি এতো অধৈর্য হবেন না। দেখুন আমি একেবারে সুস্থ। আমার জন্য আপনি এতো উতলা হচ্ছেন কেন?
ইউকেলিসের তালাশে আরেকজন অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী হয়রান পেরেশান হয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। কিন্তু কাউকে কিছু বলছে না। সে যেন প্রায় পাগলিনী। সে ঐ খ্রিস্টান যুবতী যাকে ইউকেলিস কুস্তুনতীনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। এ যুবতীর সাথে ইউকেলিসের আলেপ্পা শহরে দেখা হয়েছে এবং বেশ কয়েকবার তাদের অভিসার হয়েছে। তার নাম রোজী। সেও ইউকেলিসের সন্ধানে কেল্লার প্রাচীরের উপর উঠে দেখল, দূরে ইউকেলিস লীজার কাছে দাঁড়ান। সে আর সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ছুটে এল ইউকেলিসের নিকটে। ইউকেলিস দেখল, তার দিকে তার প্রেয়সী এলোকেশে ছুটে আসছে। যেন উন্মাদিনী। ইউকেলিস নিজেকে তার মায়ের স্নেহপরশ থেকে মুক্ত করে দুহাতে রোজীকে জড়িয়ে ধরল।
***
শহরের বাইরে মুজাহিদরা তাদের শহীদ সঙ্গীদের লাশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলারা আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করছে। এরা মুজাহিদদের স্ত্রী, মেয়ে, মা। এরা মুজাহিদদের সাথেই এসেছে। এরা অবরোধ থেকে কিছুটা দূরে এক নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছে। এদের সাথে শারীনাও এসেছে। সে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কন্যা। বর্তমানে আরবের খাজরাজ বংশের মুজাহিদ হাদীদ ইবনে মুমিনের স্ত্রী। অন্যান্য নারীদের সাথে সেও অসুস্থ ও জখমীদের পানি পান করাচ্ছে। তাদের তুলে নিয়ে তাঁবুতে শুইয়ে দিয়ে ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে। পট্টি বেঁধে দিচ্ছে।
মুজাহিদরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এমন হয়নি যার প্রতিক্রিয়ায় অবরোধ শিথিল হয়ে যাবে। জখমীদের সংখ্যা একটু বেশী। কিন্তু তাতেও অবরোধ কার্যক্রমে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) শহরের যেদিক থেকে অবরোধ তুলে নিয়েছিলেন সেদিকে একদল অশ্বারোহী মুজাহিদ পাঠিয়ে দিলেন। এছাড়া আর তেমন কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হল না। কেল্লায় আক্রমণেরও কোন পরিকল্পনা করলেন না। বরং পূর্বের ন্যায় মুজাহিদর অবস্থান করতে থাকল।
পুনরায় আক্রমণের জন্য উভয় পক্ষের কিছুটা অবকাশের প্রয়োজন। যেন অসুস্থ ও সাধারণ জখমীরা সুস্থ হয়ে উঠে। আন্তোনীস ও রূতাস পুনরায় আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। কবিলার সর্দারদের সাথে বারবার আলোচনা পর্যালোচনা ও পরামর্শ হচ্ছে। সর্দারদের মাধ্যমেই পরবর্তী সিদ্ধান্তের কথা যোদ্ধাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। কেল্লায় অবস্থিত খ্রিস্টানদের অবস্থা এমন হল যে, কিশোররা পর্যন্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। নারীরাও বলাবলি করতে লাগল, প্রয়োজন হলে তারাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।
মুসলমানদের শিবিরে নিয়ম হচ্ছে, নামাযের জামাতে সিপাহসালার ইমাম হন। ফযরের নামাযের পর সিপাহসালার খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে মুজাহিদদের তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে দুচারটি কথা বললেন। তিনি প্রায়ই একথা বলেন, আল্লাহর রাজত্বের কোন সীমা নেই। জিহাদ আল্লাহর নামে হওয়া চাই। আল্লাহই তার বিনিময় প্রদান করবেন। মাঝে মাঝে একথাও বলেন, আমল ছাড়া দুআ এবং দুআ ছাড়া আমলের অবস্থা ঐ উদ্ভিদের ন্যায় যা মাটি ভেদ করে ঝলমলে দুনিয়ায় এসেছে। কিন্তু পানি না পাওয়ার কারণে শুকিয়ে মরে গেছে।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সরাসরি মুজাহিদদের কিছু বলতে চাইলে ফজরের নামাযের পর বা অন্য কোন নামাযের পর বলেন। তিনি মুজাহিদদের সদা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, যে কোন সময় যে কোন মুহূর্তে আবার আক্রমণ হতে পারে। সুতরাং আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি এ তথ্য পেয়েছেন আহত খ্রিস্টান যোদ্ধাদের থেকে। তারা বলেছে, আবার আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। তারা আরো বলেছে, শহরে খাদ্যশস্যের দারুণ সংকট। আর কিছুদিন পরই শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। তিনি একথাও জেনেছেন, শহরের লোকেরা দ্রুত অবরোধ ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। শহরে এমন মানুষও রয়েছে যারা মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নিতে রাজী আছে। আলেপ্পা শহরের ভিতরের অবস্থা জানার পর খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) এর জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরী করা সহজ হয়ে গেল।
এদিকে কেল্লার মাঝেও আত্মরক্ষামূলক আক্রমণের আলোচনা চলছে। আন্তোনীস ও রূতাস দুতিন দিন পর একেবারে প্রত্যূষে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল। যারা জখমী হয়েছিল তাদের অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠেছে। পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী লোক আক্রমণে অংশগ্রহণ করবে। তারা এখন পূর্ণ প্রস্তুত। আন্তোনীসের ইচ্ছা হল, এ আক্রমণ হবে চূড়ান্ত। তাই এবার আর দুদরজায় নয়, চার দরজা দিয়ে বেরিয়ে আক্রমণ করতে হবে। কেল্লার চারদিক দিয়ে হবে এ আক্রমণ।