***
আলেপ্পা শহরের দুদিক থেকে দুটি অশ্বারোহী বাহিনী পশ্চাৎ গমনের কারণে শহরবাসীদের মাঝে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) কিছুই জানতে পারেননি। শহরে যে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিয়েছে তাও তিনি জানতে পারেননি।
একদিন খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সাথী ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-এর সাথে পরামর্শ করে শহরের এক পার্শ্বের অবরোধ তুলে নিলেন এবং মুজাহিদদের দূরে পাঠিয়ে দিলেন।
সেদিন আন্তোনীস, রূতাস ও কবিলার সর্দাররা কেল্লার সুউচ্চ পাঁচিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখল, অবরোধকারী মুজাহিদ বাহিনী শহরের এক পার্শ্ব থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন তাদের আর আনন্দের সীমা রইল না।
আন্তোনীসের কণ্ঠে গর্ব ও অহঙ্কার ভরা আত্মবিশ্বাসের সুর ফুটে উঠল। বলল, আমরা আর বেশী অপেক্ষা করতে পারি না। কাল সকালেই এদিকের দুটি দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ব। তারপর মুসলমানদের ধূলির সাথে মিশিয়ে তবে ফিরব।
পূর্বাকাশ আলোকিত। পৃথিবী আলোয় উদ্ভাসিত। আলো ছড়াতে ছড়াতে সূর্য কিছুটা উপরে উঠে এসেছে। অকস্মাৎ শহরের দুটি দরজা খুলে গেল। শহরের লোকেরা বাধভাঙা বন্যার পানির ন্যায় তলোয়ার বর্শা নিয়ে মার মার কাট কাট রব তুলে বেরিয়ে এল। তাদের অনেকেই অশ্বারোহী।
এমন পরিস্থিতির জন্য মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল না। এ ধরনের হামলা প্রতিহত করার জন্য তারা সুযোগই পেল না। তবে সালারদের পক্ষ থেকে নির্দেশ ছিল, তারা যেন সর্বদা সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে। তাই একেবারে ভেঙে পড়ল না।
আক্রমণের কৌশল আন্তোনীস অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে তৈরি করেছিল। তাই এমন হল না যে একদিক থেকে আক্রমণ করল আর পিছন দিক থেকে মুজাহিদ বাহিনী এসে তাদের ঘিরে ফেলল। সে শহরের যোদ্ধাদের শিখিয়ে দিয়েছে, কেল্লা থেকে বেরিয়েই তারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। ডানে ও বামে চলে যাবে। তাহলে পশ্চাৎ দিক থেকে তারা নিরাপদ থাকবে। এক দলের সালার আন্তোনীস। আরেক দলের সালার রূতাস। ইউকেলিস রূতাসের সাথে তার সহযোগী হিসাবে রইল।
অপ্রস্তুত, অসচেতন ও অলসতা ঝেড়ে ফেলে যখন মুজাহিদ বাহিনী উঠে দাঁড়াল এবং অত্যন্ত শক্ত হাতে তাদের প্রতিহত করল তখন শহরের লোকেরা বুঝতে পারল যে তারা এক কঠিন বিশাল পাথরের সাথে আঘাত খেয়েছে। এ জগদ্বল পাথর ঠেলে সামনে অগ্রসর হওয়া এক অসম্ভব কাজ।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ভেবেছিল, যদি শহরের লোকেরা কেল্লার বাইরে এসে আক্রমণ করে তাহলে কিছু মুজাহিদ আক্রমণকারীদের পশ্চাতে চলে গিয়ে খোলা দরজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করবে। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কারণ আন্তোনীস শহরের যোদ্ধাদের দুভাগে ভাগ করে পশ্চাতে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
ভীষণ যুদ্ধ শুরু হল। ক্ষুধার্ত শার্দুলের ন্যায় একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীর, বর্শা আর তলোয়ারের যুদ্ধ শুরু হল। রণহুঙ্কারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। আন্তোনীস ও রূতাস প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদের মতই শহরের যোদ্ধাদের পরিচালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু আসলে তো তারা সৈন্য নয়। যুদ্ধের কলা-কৌশল তাদের জানা নয়। তারা এক বিশৃঙ্খল জনতার ঢল। তারা বাঁধ ভাঙা স্রোত। তাদের একটিই ইচ্ছা, মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা। কিন্তু বিশৃঙ্খলতার কারণে ফলাফল হল একেবারে বিপরীত। অধিকাংশ মুজাহিদ অশ্বারোহী হওয়ার সুবাদে নিরাপদে ও অত্যন্ত সহজে শহরের যোদ্ধাদের ধরাশায়ী করতে লাগল।
আন্তোনীস সজাগ। সতর্ক তার দৃষ্টি। সে মুসলমানদের গতি প্রকৃতি দেখে বুঝে ফেলল, মুসলমানরা কেল্লার দরজায় পৌঁছতে চাচ্ছে। শহরের যোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা ক্রমেই দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে সে তার কর্তব্য নির্ধারিত করে ফেলল। শহরের যোদ্ধাদের নির্দেশ দিল তারা যেন কাল বিলম্ব না করে শহরে প্রবেশ করে। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দিচ্ছে না। আন্তোনীস দেখল, সামনে কঠিন পরীক্ষা। কবিলার সর্দারদের ডেকে বলল, তারা যেন তাদের গোত্রের যোদ্ধাদের শহরে প্রবেশের নির্দেশ দেয়। সর্দারদের নির্দেশ পাওয়া মাত্র যোদ্ধারা শহরে প্রবেশ শুরু করল।
মুজাহিদরা তাদের পশ্চাৎগমন করল। তাদের ধারণা ছিল, শহরের যোদ্ধাদের। সাথে তারাও শহরে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু তারা তড়িঘড়ি করে বহু যোদ্ধাকে বাইরে রেখেই দরজা বন্ধ করে দিল। যারা বাইরে আটকা পড়েছিল তারা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগল। অপরদিকে শহরের যোদ্ধারা কেল্লার পাচিলের উপর থেকে মুজাহিদদের লক্ষ্য করে অব্যর্থ তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করতে লাগল। মুজাহিদরা এতে ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হল। ফলে তারা নিরাপদ স্থানে চলে গেল। শহরের বাইরে থাকা যোদ্ধারা এই সুযোগে সহজেই শহরে প্রবেশ করল।
কেল্লার উঁচু প্রাচীরে দাঁড়িয়ে যোদ্ধারা বাইরের হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখতে পেল। নিকটে দূরে বহু লাশ ছড়িয়ে আছে। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। অনেকে আক্রান্ত হয়ে উঠে আসতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। একটু অগ্রসর হয়েই আবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। এ দৃশ্য বিভিন্ন কবিলার খ্রিস্টান যোদ্ধাদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিল। তারা ঘোষণা করল, তারা আরেকটি আক্রমণ করবে। তা হবে মরণপণ আক্রমণ। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর আক্রমণ। মুসলমানদের জীবনের তরে যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দিতে হবে।