এক ব্যক্তি অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, আমরা আর ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। আর অপেক্ষা করতে পারব না। আমরা সবাই কেল্লা থেকে বেরিয়ে এখনি মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই। বীরের মত যুদ্ধ করে মরতে চাই।
আন্তোনীস রোমান বাহিনীর সালার ছিল। রূতাসও যুদ্ধে কম দক্ষ নয়। যুদ্ধের কলা-কৌশল সম্পর্কে তারা সম্যক অবহিত। তারা জানে, কেল্লায় অবরুদ্ধ থাকার পর কখন কোন পরিস্থিতিতে কেল্লার বাইরে গিয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ করতে হয়। তাই তারা লোকদের বিভিন্নভাবে বুঝাল। কিন্তু উত্তেজিত জনতার এক কথা, এক দাবী।
এক বৃদ্ধ ব্যক্তি বলল, হে রোমান সালার! আমরা মুসলমানদের সাথে শত্রুতা রাখতে চাই না। যদি তোমরা বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে না চাও তাহলে আমরাই কেল্লার দরজা খুলে দিব।
আন্তোনীসের কণ্ঠ এবার একটু কঠিন হয়ে উঠল। বলল, তুমি মূর্খ। তুমি তো মুসলমানদের জন্য কেল্লার দরজা খুলে দিবে না বরং এ দেশে ইসলাম প্রবেশের সুযোগ করে দিবে। ওরা শহরে প্রবেশ করলে সর্বপ্রথম তোমাদের ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করবে। তোমাদের শুধু ধর্মই ছাড়তে হবে না। ঘরের সুন্দরী মেয়েদের ও রূপসী স্ত্রীদের মায়াও ছাড়তে হবে। তোমরা তোমাদের জাতীয় পরিচয় নিমিষে হারিয়ে ফেলবে।
রূতাস উচ্চকণ্ঠে বলল, হে কুশধারীরা! যে মুসলমানদের জন্য তোমরা দরজা খুলে দিতে চাচ্ছো, তোমরা যাদের আনুগত্য মেনে নিতে চাচ্ছো, তাদের হিংস্রতা ও বর্বরতা দেখো যা বীভৎস বিকৃত লাশ হয়ে তোমাদের সামনে পড়ে আছে। তারা তোমাদের নিষ্পাপ দুগ্ধপোষ্য সন্তানকেও জ্বালিয়ে দিয়েছে। যদি তোমরা আজ আত্মসমর্পণ কর তাহলে যে-ই ইসলাম গ্রহণে অস্বীকার করবে তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করবে।
এক বৃদ্ধ আগে বেড়ে বলল, হে রোমান সালার! যেখানে যুদ্ধ হয় সেখানে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চলে। তুমি কি ভুলে গেছো, রোমান ও ইরানী সৈন্যরা যেদিক দিয়েই গেছে নির্বিচারে হত্যা করেছে। নিষ্পাপ শিশুদের দুহাতে হত্যা করেছে। যুবতী মেয়েদের কৌমার্য রক্তাক্ত করেছে। কিশোর-বালকদের হত্যা করেছে, বাকীদের গোলাম বানিয়ে নিয়ে গেছে। আর আমরা তো ইচ্ছে করে মুসলমানদের শত্রু বানিয়েছি। আমরা রোমানদের সমর্থন দিয়েছি, তাদের সাহায্য করেছি। অথচ রোমানরা যুদ্ধ না করে পালিয়ে গেছে। তাই মুসলমানরা
আমাদেরকে কেন দুশমন মনে করবে না? যদি নারী ও শিশুদের জন্য তোমার এতোই দরদ উথলে উঠে তাহলে আর কালক্ষেপণ নয়, এবার চল কেল্লার বাইরে। গিয়ে যুদ্ধ করি। দেখবে, শহরের শিশু-কিশোররাও যুদ্ধ করবে। হাসতে হাসতে প্রাণ বিলিয়ে দিবে।
শহরের প্রায় সকল মানুষ সেখানে সমবেত হয়েছিল। বৃদ্ধের এই কথা শোনার পর লোকেরা চিৎকার শুরু করল। বলতে লাগল, মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে আমরা অবরোধ ভেঙে ফেলব। যখন এ চিৎকার ও হট্টগোল চলছে ঠিক তখন আরেক ব্যক্তি উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ভাইয়েরা আমার! আমাদের উপর আরেকটি বিপদ এগিয়ে আসছে। শহরে খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। গৃহপালিত পশু ও ঘোড়ার খাবারের চরম সংকট। জমিজমা সব কেল্লার বাইরে। বাইরে থেকে কোনকিছু আনা সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের আগেই এই প্রাণীগুলো মারা যাবে। তাই বলছি, অনাহারে হাড় জিরজিরে হয়ে ছটফট করতে করতে না মরে এটাই কি উত্তম নয় যে, আমরা আমাদের ধর্মের জন্য, আমাদের স্বাধীনতার জন্য, ইজ্জত সুরক্ষার জন্য যুদ্ধ শুরু করি! যুদ্ধ করতে করতে জীবন বিলিয়ে দেই!
আন্তোনীস ও রূতাসের মস্তিষ্কের টিস্যুতে টিস্যুতে শুধু যুদ্ধ আর অবরোধের চিন্তা সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ রঙিন স্বপ্নে সর্বদা বিভোর, বিজয় তাদের হবে। কিন্তু তারা একথা ভাবেনি যে, যুদ্ধ জয়ের বিশেষ কিছু কৌশল আছে। কিছু দাবীও আছে। যে শহরে যোদ্ধারা থাকে সেখানে খাদ্যসামগ্রী ও রসদপত্রও এতো থাকা চাই এক বৎসর বা তার চেয়ে বেশী সময় তারা তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন নির্বাহ করতে পারে। আলেপ্পায় কোন সৈন্য ছাউনী ছিল না। শহরের কেউ কখনো খাদ্য মজুদের প্রয়োজনও অনুভব করেনি। মুসলমানরাও সেখানে কোন সৈন্য ছাউনী তৈরি করেনি। তাই সেখানে অতিরিক্ত খাদ্যের মওজুদ নেই। এখন শহরের লোকেরা অনুভব করল যে, দ্রুত খাদ্য শস্য ফুরিয়ে যাচ্ছে। গৃহপালিত পশুর খাবারেরও তীব্র সংকট।
এ এমন এক সমস্যা যার সমাধানের কোন পথ খোলা নেই। আন্তোনীস ও রূতাস এবার একেবারে নিরব হয়ে গেল। এমন কোন সমাধান তাদের মাথায় এল না যা শুনিয়ে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করা সম্ভব। দিশেহারা আন্তোনীস। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রূতাস। অবশেষে আন্তোনীস কবিলার সর্দারদেরকে ডেকে নির্জন স্থানে নিয়ে বসল। তাদের সামনে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরে বলল, এখন আমাদের বাইরে বেরিয়ে যুদ্ধ করেই অবরোধ ভেঙে ফেলতে হবে। যদি আমরা এ অপেক্ষায় থাকি, মুসলমানরা এক সময় অবরোধ তুলে চলে যাবে, তাহলে শহরের লোকেরা ক্ষুধা পিপাসায় মৃত্যুর ভয়ে নিজেরাই শহরের দরজা খুলে দিবে আর তার ফলাফল কত ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমেয়।
কবিলার সর্দাররা চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত দিল যে, এখন আক্রমণ করেই অবরোধ ভেঙে ফেলতে হবে। এ ছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। আন্তোনীস সর্দারদের বলল, সে শহরের যুদ্ধে সক্ষম লোকদের একত্রিত করে যুদ্ধের কলা-কৌশল ও প্রয়োজনীয় বিষয় শিখিয়ে দিবে।