ইউকেলিসের অবস্থা এমন যে যুদ্ধের নেশায় সে তার মায়ের কথাও ভুলে গেছে। এখন খাবার দাবারেরও তার কোন নিয়মানুবর্তিতা নেই। ৫ ৩৯
যেদিন মুসলমানদের নিক্ষিপ্ত অগ্নি-তীরের কারণে কেল্লার মাঝে অবস্থিত বিভিন্ন কবিলা থেকে আগত লোকদের তাঁবুতে আগুন লেগে গিয়েছিল, তাঁবুর লোকদের ডাক-চিৎকারে সবাই অস্থির হয়ে পড়েছিল, সারি সারি তাঁবুতে আগুন লেগে প্রলয় কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল, নারী পুরুষ আর শিশুরা তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হচ্ছিল, অনেকেই জ্বলে পুড়ে মরেছিল, বহু চেষ্টার পর অল্প কিছু তবু আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছিল, সেদিন মানুষের মাঝে চরম হতাশা ও অতিষ্ঠতা দেখা গেছে। অনেকেই বলেছে, আর নয়। মুসলমানদের হাতেই শহর তুলে দাও। এভাবে জ্বলে পুড়ে মরার কোন অর্থ নেই। আজ তাবুতে আগুন লেগেছে। কাল বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগবে। জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেলে জীবনের আর অর্থ রইল কোথায়?
সেদিন আন্তোনীস, ইউকেলিস ও রূতাস সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আগুন নিভাচ্ছিল। তখন আন্তোনীস আর নিজেকে ধারণ করতে পারেনি। সমবেত মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগল, ভাইয়েরা আমার! স্বজাতির জন্য, আযাদির জন্য এমন একটু আধটু কুরবানী দিতেই হবে। এই মুসলমানদের কথাই ভেবে দেখ। তারা কতদূর থেকে ছুটে এসেছে। একের পর এক যুদ্ধ করছে। এতো ক্ষতির মুখোমুখি হয়েও তারা এখনো আমাদের অবরোধ করে আছে।
আন্তোনীস একটু বিরতি দিয়েই আবার বলতে লাগল, আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি, মুসলমানরা অবরোধে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তারা তাদের কতিপয় সৈন্যকে ইতিমধ্যে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি এখন নিশ্চিত যে, শীঘ্রই মুসলমানরা অবরোধ তুলে পালিয়ে যাবে। সুতরাং এমন কথা কিছুতেই বলবে না যে, শহর মুসলমানদের হাতে তুলে দাও।
আন্তোনীস শহরবাসীদের অত্যন্ত উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করল। তার ইঙ্গিতে ইউকেলিস একটি ঘোড়ায় আরোহন করল। সবাই তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইউকেলিস অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠে বলল, হে সধারীরা! হে ঈসা মসীহ-এর ভক্তরা! আমার দিকে তাকাও! আমার বয়স দেখ! এ বয়স কি হাসি আনন্দ ও আমোদ-স্ফুর্তির নয়? উপরন্তু আমার এক হাত অবশ। এরপরও দেখ আমি পানাহার ও সুখনিদ্রার কথা ভুলে গেছি। তোমরা দেখছো, আমি কিভাবে এক হাত নিয়ে লড়াই করছি। আমি তোমাদের সন্তানতুল্য। তোমাদের ইজ্জত সম্মান রক্ষার্থে আমি শাহী জিন্দেগী ছেড়ে দিয়ে তোমাদের মাঝে চলে এসেছি। আমি তোমাদের সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা তোমাদের সাথে থাকব, আছি।
***
তাঁবুর আগুন যখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে এলে আন্তোনীস ও ইউকেলিস লোকদের উদ্দেশ্যে এক অগ্নিঝরা বক্তৃতা দেয়। তখনো আগুনে পোড়া লাশগুলো খুঁজে এনে একত্রিত করা হয়নি। আন্তোনীস ও ইউকেলিসের বক্তৃতায় সবাই উদ্বুদ্ধ ও উদ্বেলিত হয়। শহরে যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল তা দূর হয়ে যায়। এক অভিনব শক্তিতে যেন সবাই বলিয়ান হয়ে উঠে।
সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত কোথাও কোথাও আগুন জ্বললেও শীঘ্রই তা আয়ত্বে চলে আসে। যে সব লোক জ্বলন্ত তাঁবু থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল এবার তারা তাদের ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী পরিজনদের তালাশ করতে থাকে। পোড়া তাবুর মাঝ থেকে খুঁজে খুঁজে বীভৎস বিকৃত লাশগুলো একের পর এক বের করে এনে একজায়গায় পাশাপাশি শুইয়ে রাখে।
সূর্য উদিত হলে শহরের লোকেরা একে একে পোড়া তাঁবুগুলোর নিকট আসতে লাগল। তারা সারিবদ্ধ বিকৃত লাশগুলো দেখতে পেল। যুবক ছেলের লাশ, যুবতী মেয়ের লাশ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার লাশ, কিশোর-কিশোরীর লাশ। সবাই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। কাউকে চেনার বা সনাক্ত করার কোন উপায় নেই। কিছু কিছু পুড়ে এমন হয়েছে যেন পোড়া কাষ্ঠখণ্ড।
মহিলারা সন্তানের লাশ নিয়ে বিলাপ করে করে কাঁদছে। কেউ কেউ আত্মহারা হয়ে নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ছে। স্বজনহারা সবাই হয়রান পেরেশান। স্বজনের তালাশে ছুটাছুটি করছে। সকলের চোখে অশ্রু। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ।
এ ভয়াবহ বীভৎস অবস্থা দেখে শহরের লোকেরা ক্ষীপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে উঠল। আন্তোনীস ও ইউকেলিসের গত দিনের বক্তৃতার কথা তারা ভুলে গেল। এক ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে বলল, কোথায় আমাদের সেই রোমান সিপাহসালার? পুড়ে মরলাম তো আমরাই। ধন-সম্পদ পুড়ে ছারখার হলো তো আমাদেরই। তাহলে কেন আমরা কেল্লা থেকে বেরিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করছি না? এতে বাধা কোথায়?
এ লোকদের কথা শেষ হতে না হতেই বেশ কিছু মানুষ চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, আর কেল্লায় বসে বসে মরতে চাই না। এবার প্রতিশোধ চাই। তাজা রক্ত চাই। যুদ্ধ চাই। সবার মাঝে এই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। সবাই বলছে, সেই রোমান সিপাহসালারকে ডেকে আন। এক্ষুণি ডেকে আন।
আন্তোনীস সংবাদ পেয়ে ইউকেলিসেকে সাথে নিয়ে ছুটে এল। তাদের আসতে দেখেই লোকেরা চিৎকার শুরু করল। সবাই ক্ষুব্ধ উত্তেজিত। সবাই মারমুখী উত্তপ্ত। কেউ বলে উঠল, আরে! এই রোমান সালার তো বাদশাহ হওয়ার জন্য আমাদের নিয়ে জুয়া খেলছে!
আন্তোনীস সমবেত জনতাকে কৌশলে একটু শান্ত করল। তারপর বলল, আপনারা অধৈর্য হবেন না। ক্ষীপ্ত হবেন না। এই তো দুএক দিনের মধ্যেই অবরোধ শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানরা তাদের বাহিনী সরিয়ে নিচ্ছে।