এভাবে কিছুক্ষণ পর পরই অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনী ছুটে গিয়ে কেল্লার ভিতর অগ্নিতীর বর্ষণ করতে লাগল। ইতিমধ্যে কয়েকজন পাঁচিল থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে জখম হয়েছে। কেউ পাচিলের নিকটবর্তী হলেই তার উপর প্রবল তীর বর্ষণ শুরু হয়। ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) অশ্বারোহীদের অগ্নিতীর বর্ষণ করতে নিষেধ করলেন। ভাবলেন, এভাবে জীবনের ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।
ইতিমধ্যে পাঁচিলের উপর থেকে রব উঠল, আগুন, আগুন। সাথে সাথে কেল্লার ভিতর থেকে ধোঁয়া কুণ্ডুলী পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠতে লাগল। সাথে সাথে তাঁবুর লোকদের ডাক-চিৎকার আহাজারী চারিদিক কাঁপিয়ে তুললো।
সারি সারি তাঁবু। সবগুলো তাঁবু পাশাপাশি। তাই এক তাবুর আগুনে প্রথমে চার তবু জ্বলে উঠল। চোখের পলকে চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। তাঁবুর ভিতর থেকে যারা প্রাণপণে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে তাদের অনেকেরই কাপড় পুড়ে গেছে। গা পুড়ে গেছে। অনেকে বেরিয়ে আসতে না পেরে জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। কেল্লার পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে যে সব খ্রীস্টানরা তীর নিক্ষেপ করছিল তারা ভয়ে আতঙ্কে সেখান থেকে ছুটে আগুন নিভাতে চলে গেল। পাঁচিলের বিরাট অংশ খালি হয়ে গেল।
মুজাহিদরা এই সুযোগে রশি নিয়ে এসে আংটাসহ পাঁচিলে নিক্ষেপ করল। আংটা লক্ষ্যস্থানে পৌঁছে আটকে গেল। সাথে সাথে মুজাহিদরা রশি বেয়ে পাঁচিলের উপরে উঠতে লাগল। কিন্তু ডান ও বাম দিক থেকে তাদের উপর বৃষ্টির ন্যায় তীর বর্ষিত হতে লাগল। পশ্চাতে অবস্থানরত অনেক মুজাহিদ দৌড়ে সামনে এগিয়ে এল। তারা পাঁচিলে অবস্থানরত খ্রীস্টান সৈন্যদের উপর তীর নিক্ষেপ শুরু করল। কয়েকজন খ্রীস্টান সৈন্য মুজাহিদদের তীরের আঘাতে আক্রান্ত হয়ে পাঁচিলের উপর থেকে লুটিয়ে নীচে পড়ে গেল। তারা সফল হল না। যে সব মুজাহিদ রশি বেয়ে উপরে উঠছিল তারা তীরের আঘাতে জর্জরিত হল। তারা বাধ্য হয়ে নীচে নেমে এল। এ অবস্থা দেখে বেশ কিছু মুজাহিদ শাহাদাঁতের তামান্নায় অধীর হয়ে রশির দিকে দৌড়ে যেতে চাইল। কিন্তু সালাররা তাদের পথ আগলে ধরল। অপর দিকে পাঁচিলের যে স্থানে রশি-আংটা লেগেছিল, খ্রীস্টান সৈন্যরা তা খুলে ফেলে এবং রশি নীচে পড়ে যায়।
শহরের ভিতরের ডাক-চিৎকার আর আর্তনাদে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, সেখানে কী কিয়ামত ঘটছে। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) যে ভয় ও আতঙ্ক শহরের লোকদের মাঝে সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন তা বাস্তবায়িত হল। তিনি তীরন্দাজ বাহিনীকে এবং যারা পাঁচিলে উঠার সুযোগ খুঁজছে তাদের পিছু হটিয়ে নিয়ে এলেন।
রাতে মুজাহিদ বাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দল কেল্লার ফটকের নিকটবর্তী। হয়ে কুঠার দিয়ে ফটক ভাঙ্গার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রহরীদের তীর বর্ষণের কারণে তারা ফিরে আসতে বাধ্য হল। প্রহরীরা তাদের উপর জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে মারল। ফলে কয়েকজনের কাপড়ে আগুন লেগে গেল এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গা পুড়ে গেল।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) একদিন এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদের এক বাহিনীকে অবরোধ তুলে পশ্চাতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তারা এমনভাবে চলে গেল যেন আর ফিরে আসবে না। এরা ঐ এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদ যাদেরকে রূতাস কেল্লার পাঁচিল থেকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে লীজাকে বলেছিল, হয়তো মুসলমানরা নিরাশ হয়ে অবরোধ তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আরেকটি কৌশল অবলম্বন করলেন। তা হল, মুজাহিদদের সকল কর্মতৎপরতা একেবারে বন্ধ করে দিলেন। অথচ মুজাহিদরা এমন শৌর্যবীর্য ও বীরত্ব প্রদর্শন করেছে যে, কয়েজন মুজাহিদ তীব্র তীর বর্ষণের মাঝেও কুঠার নিয়ে কেল্লার ফটকের দিকে ছুটে গেছে এবং ফটক ভাঙার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু কেল্লার পাঁচিলের উপর থেকে ক্রমাগত নিক্ষেপিত তীর ও বর্শার আঘাতে তারা অবিচল থাকতে পারেনি। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ফিরে এসেছে। এমন কি এক দুঃসাহসী মুজাহিদ শহীদও হয়েছেন।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর নির্দেশে অবরোধের অপর পার্শ্ব থেকে আরো এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদ পশ্চাতে চলে গেলেন। তারাও এমনভাবে পশ্চাতে চলে গেল যেন আর ফিরে আসবে না। তারা একটি পাহাড়ের পশ্চাতে অদৃশ্য হয়ে গেল। এদিকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) শহরের চতুস্পার্শ্বে টহল দিতে থাকলেন আর অন্যান্য মুজাহিদরা তাবুতে গা ঢাকা দিয়ে আছে। অনেকে গাছ বা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।
কেল্লার ভিতর আন্তোনীসের যেন আনন্দের শেষ নেই। বিজয় আনন্দে তার মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত, কিন্তু তারপরও তার বিশ্রাম নেই। কখনো সে কবীলার সর্দারদের একত্রিত করে উপদেশ বাণী বিতরণ করছে। কখনো কেল্লার পাঁচিলে গিয়ে টহলরত লোকদের উৎসাহিত উদ্বেলিত করছে। কখনো নীচে নেমে এসে সমবেত লোকদের বিজয়ের সুসংবাদ দিচ্ছে। আর বলছে, এখনো আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। এই মুসলমানদের শুধু তাড়িয়ে দিলেই হবে না। তাদের মৃত-লাশে পরিণত করতে হবে। আর যারা প্রাণে বেঁচে যাবে তাদের পশুর মত কেল্লায় এনে বন্দী করে রাখতে হবে।
আন্তোনীস যেন পাগল হয়ে গেছে। ভ্রান্ত বিজয়ের নেশায় সে দুনিয়ার সব লোভনীয় বস্তুর কথাও ভুলে গেছে। লীজাও যেন তার অন্তর থেকে হারিয়ে গেছে। লীজাও তার থেকে বিমুখ হয়ে গেছে। আগের মত আর তাকে জিজ্ঞেস করে না, কেন সে সময়মত ঘরে আসে না! তার খাওয়া দাওয়ার প্রতি যত্ন নেয়া না। ঘরে এলে মনে হয় অন্তর তার বাইরে বাইরে ঘুরছে। আন্তোনীসের স্থানে এখন রূতাস লীজার নিকট যায় আবার লীজাও সময় সুযোগে রূতাসের নিকট গমন করে।