লীজা মৃদু হেসে শ্লেষভরা কণ্ঠে বলল, রূতাস! তুমি এক নির্বোধ। গুপ্তচর বাহিনীর উচ্চ পদস্থ অফিসারের আরো সতর্ক হওয়ার দরকার। চিন্তা কর, গভীরে পৌঁছ। পশ্চাৎপসরণ আর পরাজয়ের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তার আলোকে ভেবে দেখ। আন্তোনীসতো এমন সুখ স্বপ্নে বিভোর যার কোন ব্যাখ্যা নেই। এ অল্প মুসলিম মুজাহিদই তো লাখ লাখ ইরানী ও রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের পরাভূত করেছে। নিষ্পেষিত করেছে। আন্তোনীস এ অশিক্ষিত অচেতন অদূরদর্শী কবিলার লোকদের নিয়ে কিভাবে সেই অজেয় মুসলিম শক্তিকে পরাজিত করবে! তুমি নিশ্চয় বুঝ এটা অবরোধ। আমরা মজবুত কেল্লায় আবদ্ধ হয়ে নিরাপদে আছি। তাই মুসলমানদের সময় লাগছে। যদি খোলা প্রান্তরে হত, তাহলে দেখতে, সূর্যাস্তের আগেই মুসলমানরা এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করত।
রূতাস হালকা ব্যঙ্গ করে বলল, লীজা! তুমি এতো নিরাশ। মনে হয় তুমি আন্তোনীস ও ইউকেলিসের সাথেও এমন ধরনের কথা বল।
লীজা বলল,না, তাদের সাথে এ ব্যাপারে আমি কোন কথাই বলি না। তাদের বিশ্বাস যে, মুসলমানরা অবরোধ তুলে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। তারপরই লীজা রূতাসকে আরো কাছে টেনে এনে কামনায় ভেঙে পড়া কণ্ঠে নীচু স্বরে বলল, রূতাস! তুমি এসব কথা ছাড়। আমি কি চাচ্ছি বুঝ…?
রূতাস যুবক। যৌবনের জোয়ারে তার শরীর প্লাবিত। তাছাড়া সে কোন দুনিয়া বিরাগী পাদ্রী বা সন্নাসীও নয়। তার শরীরের ঘুমন্ত পৌরুষ জাগ্রত হয়ে উঠল। রূতাস বেকারার অস্থির হয়ে উঠল। সহজেই লীজার পাতানো জালে আটকে গেল। যেমন মাকড়সার জালে মাছি আটকে যায়।
রূতাসের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা ও ভয়। বলল, লীজা! ক্ষণিকের জন্যও কি ভেবে দেখেছো, যদি আন্তোনীস আমাদের এই বন্ধুত্বের কথা জানতে পারে, তাহলে কি হবে?
লীজা একটু শ্লেষভরা কণ্ঠে বলল, তাহলে আর কি হবে। আন্তোনীস হয়তো তোমাকে হত্যা করবে।….. কিন্তু আমরা তাকে সে বিষয় জানতে দিব কেন?
তারপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। লীজা ধীর পায়ে চলে এল।
***
২. অবরোধ তীব্র আকার
অবরোধ তীব্র আকার ধারণ করল। মুজাহিদরা শহরে তীর নিক্ষেপ শুরু করল। কিন্তু একটি সমস্যা দেখা দিল। তা হল কেল্লার পাঁচিল এতো উঁচু যে, তার উপর দিয়ে গিয়ে অগ্নিতীর লক্ষ্যে পৌঁছছে না। খুঁজে একটি উঁচু জায়গা পাওয়া গেলো। মুজাহিদরা সেখানে অবস্থান নিয়ে অগ্নি তীর নিক্ষেপ শুরু করল। কেউ কেউ উঁচু গাছের মগডালে উঠে সেখান থেকে অগ্নি তীর নিক্ষেপ করছে। কিন্তু কেল্লার ভিতরের মানুষের ঘরবাড়ি কেল্লার পাঁচিল থেকে দূরে। তাই অগ্নিতীর তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
যারা গাছের মগডালে চড়ে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করছে, তাদের একজন হঠাৎ দেখতে পেল, কেল্লার ভিতরে একদিকে সারি সারি তাঁবু দেখা যাচ্ছে। অবশ্য সে দিকে পাচিলের নিকেট কোন উঁচু স্থান নেই। কোন গাছও নেই। তবে সেদিকের তাঁবুগুলো একেবারে কেল্লার পাঁচিল পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন কবিলা থেকে আগত খ্রিস্টান যোদ্ধারা এখানে তাঁবু স্থাপন করে অবস্থান নিয়েছে। অবশ্য এর ব্যবস্থাপনায় ছিল এ শহরের প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত বন্দী মুসলমানরা। তারাই তাদের থাকার জন্য এ উন্মুক্ত প্রান্তরে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
সে সাথে সাথে দৌড়ে গিয়ে এ সংবাদ সালারদের নিকট পৌঁছে দিল। বলল, যদি সেদিক থেকে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করা হয় তাহলে তা পাঁচিলের উপর দিয়ে গিয়ে তাঁবুর উপরে পড়বে।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) সংবাদ পেয়ে সেই গাছের নিকট গেলেন এবং তার মগডালে চড়ে স্বচক্ষে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলেন। গাছ থেকে নেমে এসে খালিদ (রা.) বললেন, ইবনে গানাম! আল্লাহর শপথ করে বলছি, যদি আমরা শহরে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারি, শহরবাসীদের অন্তরে ভয় সঞ্চারিত করতে পারি, তাহলে মনে করবে, আমরা অর্ধেক বিজয় লাভ করে ফেলেছি।
ইয়ায ইবনে গানামের মনে আত্মবিশ্বাস পরিস্ফুট। বললেন, সিপাহ সালার! আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে আমরাই বিজয় লাভ করব। ইনশাআল্লাহ্। কেউ তা রোধ করতে পারবে না। শহরে কোন সৈন্য নেই। শহরবাসীদের মাঝে চরম অস্থিরতা বিরাজমান। আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে, আমরা তাদেরকে প্রবঞ্চনায় ফেলব যে, আমরা অবরোধ তুলে নিচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ করেই তা করা যাবে না। প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনীর দুচারটি দলকে সরিয়ে নেয়া হোক। তারপর আমাদের তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হোক। এতে শহরের লোকেরা বুঝবে, আমরা অবরোধে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছি।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) তখন ঘোড়ায় সাওয়ার ছিলেন। অন্য ঘোড়ায় ছিলেন ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)। উভয়ের ঘোড়া ধীর পদবিক্ষেপে চলছে। পাশাপাশি চলছে। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-এর কথা শুনে ঘোড়ার বাক টেনে ধরলেন। ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-এর পিঠ চাপড়ে বললেন, ইবনে গানাম! তুমি আমাকে বিজয়ের এক আলোক রশ্মি দেখালে। এসো, নিবিড়ে কোথাও বসি এবং কিভাবে তাদের প্রবঞ্চনা দেয়া যায় তা চিন্তা করি।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) গাছ ও উঁচু স্থানের তীরন্দাজদের ডেকে একত্রিত করলেন। তারপর তাদের নিয়ে শহরের ঐ প্রান্তে গেলেন যেখানে সারি সারি তবু স্থাপন করা হয়েছে। তারপর তাদের কেল্লার পাঁচিলের থেকে বেশ দূরে দাঁড় করালেন। এখানে পাঁচিল থেকে নিক্ষিপ্ত তীর এসে পৌঁছে না। তারপর অগ্নিতীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। দেখলেন, তীরগুলো পাঁচিল অতিক্রম করে যায় না। তারপর তিনি কি যেন চিন্তা করলেন এবং একজন দুঃসাহসী অশ্বারোহী তীরন্দাজকে ডেকে কি যেন বললেন। অশ্বারোহী সাথে সাথে তৈরী হয়ে গেল। চোখের পলকে অশ্ব ছুটিয়ে পাঁচিলের নিকট পৌঁছেই ধাবমান অশ্বের উপর থেকে অগ্নিতীর নিক্ষেপ করতে করতে নিরাপদে চলে এল। কেল্লার উপর থেকে তার উপর অসংখ্য তীর বর্ষিত হলেও সে নিরাপদেই ফিরে এসেছে।