রূতাস বলল, না, না, অমন কথা বলবেন না। আমি তো এখন আমার ঘরেই যাচ্ছিলাম। সারারাত ঘুমাইনি। এখন যাচ্ছি চলুন। রূতাস লীজাকে নিয়ে তার ঘরে গেল।
রূতাস লীজাকে সসম্মানে বসাল এবং নিজে একটু দূরে বসতে চাইল। কিন্তু লীজা বাহু ধরে তাকে তার পাশে বসাল। এবং একটি হাত তার কোমড়ের উপর রাখল। রূতাস ফিক করে একটু হেসে তার থেকে দূরে সরে যেতে চাইল। কিন্তু লীজা তাকে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরল। তারপর তার সাথে এমন এক অবাধ আচরণ করল যা সে আন্তোনীসের সাথে করে যাচ্ছিল। রূতাস ধারণা করতে পারেনি যে, সে তার সাথে এমন অবাধভাবে মিশবে। তারপর লীজা কামাতুর কণ্ঠে দুচারটি আবেগময় কথাও বলল। রূতাস তো আর অল্প বয়সের বালক নয়। সে সব কিছু বুঝে ফেলল। সে লীজার চেহারায় দৃষ্টি ফেলে তার নিরব আহবানে সুখ অনুভব করল।
রূতাসের কণ্ঠ একটু বেরসিক হয়ে উঠল। বলল, আমার অন্তরে আপনার সম্মান বিদ্যমান। আপনি শাহী খান্দান থেকে পালিয়ে এসেছেন। আমিও তো সেই খান্দানেরই লোক। আমি আপনার ইহতেরাম করি। সম্মান করি। যদি এ দিকটি বাদও দেই যে আপনি শাহী খান্দানের ইজ্জত। তবে একথা তো আমি ভুলতে পারি না যে, আপনি আমার সালার আন্তোনীসের বান্ধবী।
লীজার কণ্ঠে দৃঢ়তার আভাস। এ সময় তুমিই আমার বন্ধু। তুমিই আমার সঙ্গী। আমার থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টা করবে না। এখন আমি সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী নই আর অন্তোনীসের বন্ধুও নই। এখন আমি শুধুমাত্র লীজা। আমাকে সম্মানসূচক কিছু না বলে, প্রেমের আবেশে লীজা বলে ডাক!
রূতাসের কণ্ঠ তবু নিরস শোনা গেল। বলল, লীজা! এ কথাও চিন্তা কর, পাদ্রী প্রত্যেক দিন বিজয়ের দুআ করছেন আর বার বার বলছেন, আমাদের উপর এক মহা বিপদ সমাগত। এ বিপদ থেকে মুক্তির একই উপায় তাহলো, বিগত দিনের পাপ থেকে তওবা করা। সর্বপ্রকার পাপ পরিত্যাগ করা।
লীজা বলল, আমি আপাদমস্তক পাপ। ইরানের শাহী খান্দান থেকে এক জঘন্যতম পাপের প্রতিজ্ঞা করে হিরাক্লিয়াসের হেরেমে এলাম। কিন্তু সে পাপ সংকল্পে সফল হতে পারলাম না। তারপর যখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস আমাকে বিয়ে করে অল্প কিছুদিন পরই হেরেমে নিক্ষেপ করল, তখন আমি আরেকটি পাপ করলাম।
লীজা আবেগে অধীর হয়ে একের পর এক বলে গেল, কিভাবে সে আন্তোনীসকে তার জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য কাছে টেনে নিয়েছে। কিভাবে তার সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। একথাও বললো, ইউকেলিস সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র নয়। আন্তোনীসের ঔরসজাত।
লীজা বলল, তুমি হয়তো ভুল বুঝে আছো। তুমি মনে করেছো, আমি আন্তোনীসের এই চেষ্টায় একমত যে, আমরা শামে ঈসা মসীহ-এর সাম্রাজ্য কায়েম করব। আন্তোনীসও তাই মনে করে। কিন্তু রূতাস! আমি তোমাকে সত্য কথা বলছি, আমার একমাত্র সন্তান ইউকেলিসকে সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও তার পুত্র কুস্তুনতীনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমি আন্তোনীসের হাতে ধরা দিয়েছি।
বলতে বলতে লীজা রূতাসকে এ কথাও বলে দিল যে, হিরাক্লিয়াস ও কুসতুনতীন ইউকেলিসকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু আন্তোনীস যথাসময়ে তা দেখে ফেলে তাদের প্রেরিত ঘাতকদের হত্যা করে উইকেলিসকে রক্ষা করেছে। আর আন্তোনীসও পালিয়ে এসেছে। কারণ এরপর হিরাক্লিয়াস তাকে পেলে আস্তো রাখত! নির্ঘাত হত্যা করত।
রূতাসের শান্ত কণ্ঠ। বলল, আমি এ সব কিছু শুনে বিস্মিত বা হতবাক নই। এ সব কাণ্ড শাহী খান্দানে ঘটা স্বাভাবিক। একজনের স্ত্রী অন্যজনের দাসী হয়। সম্রাটের ছেলে সম্রাটের অন্য স্ত্রী বা দাসীদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলে। তাই আমি বলব যে, রাজা-বাদশাহ আর সম্রাটদের পরাজয়ের কারণও ঐ একটিই। আমরা কি কখনো ভেবেছিলাম যে, ইরান আর রোমের মত অপরাজেয় শক্তি কখনো আরবের সাধারণ বুন্ধুদের হাতে পরাজিত হবে। আর এমন পরাজয় যে, রোম সম্রাট আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মুসলমানরা আমাদের দুশমন হতে পারে, কিন্তু রোমান গুপ্তচর হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন শ্রেণীর মুসলমানের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছি, মুসলমানদের বস্তিতে থেকেছি, তাদের তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরে ফিরেছি। তাদের মাঝে ভোগ বিলাসের কোন নাম গন্ধও নেই। তাদের সকল কাজ পাহাড়ী ঝরণার মত স্বচ্ছ। যার উপর থেকে গভীরের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। এটাই তাদের শক্তির মূল। যার কারণে কোন শক্তিই তাদের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারছে না। লীজা! আমি এখনো বলছি, আমার কথা শুন, পাপ থেকে দূরে থাক। আন্তোনীসকে নিয়ে গির্জায় যাও এবং তাকে বিয়ে করে নাও।
লীজার কণ্ঠে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল। বলল, রূতাস! তুমি আমার কথা কেন বুঝছো না। আন্তোনীসের সাথে আমার সেই ভালবাসা অবশিষ্ট নেই যা তুমি ধারণা করছে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ভালবেসেছিলাম। কিন্তু সে আমার সাথে যে আচরণ করেছে তাতে আমি বুঝে ফেলেছিলাম সে ভালবাসার উপযুক্ত পাত্র নয়। আমি তখন সালার আন্তোনীসের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তাকে ধোকা দিয়েছিলাম। আমি একজন মানুষ। তদুপরি একজন যুবতী। আমার এই নিটোল দেহের দিকে চেয়ে দেখ। তার ক্ষুধা আছে। তীব্র চাহিদা আছে। কিন্তু………..।
রূতাস তার কণ্ঠে একটু কোমলতা এনে বলল, তারপরেও লীজা! আন্তোনীসের এই প্রতিজ্ঞা ও প্রচেষ্টাকে আমাদের সম্মান করা উচিৎ। ঈসা মসীহ (আ.)-এর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সে কত মেহনত করছে। আমাদের কর্তব্য তাকে সার্বিক সহায়তা করা।