লীজা বলল, এ নাম তো আমিও শুনেছি। একদিন সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে বলতে শুনেছি, যদি খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে হত্যার কোন ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আমি মুসলমানদের শুধুমাত্র শাম থেকেই তাড়িয়ে দেব না, বরং আরব থেকেও তাড়িয়ে সমুদ্রে নিয়ে ডুবিয়ে মারব। কিন্তু আমাদের ঘাতকরা তো তার টিকিটিও ছুঁতে পারছে না।
রূতাস বলল, আপনি হয়তো জানেন না; দুই বার খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে হত্যার জন্য চারজন করে গুপ্তচর পাঠানো হয়েছিল। তাদের গায়ে ছিল মুসলমানদের পোষাক। আরবদের মত তারা অনর্গল আরবীতে কথা বলতে পারত। আমার বিশ্বাস ছিল যে, মুসলিম বাহিনীর কেউ তাদের ধরতে পারবে না। তাদের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহও করতে পারবে না। কিন্তু তারা সবাই সেখানে পৌঁছে নিহত হয়েছে। আমরা এখন যে অবরোধের মুখোমুখী আছি, এই অবরোধকারীদের সালারও স্বয়ং খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)। কেল্লার প্রাচীর ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া ও কেল্লার পতনের ক্ষেত্রে সে দারুণ অভিজ্ঞ। হঠাৎ রূতাসের দৃষ্টি কেল্লার বাইরে পড়তেই সে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ঐ তো, ঐ যে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)কে দেখা যাচ্ছে। এদিকে আসুন। এদিকে আসুন। আমি আপনাকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে দেখিয়ে দিচ্ছি।
রূতাস লীজাকে নগর প্রাচীরের এক উঁচু স্থানে নিয়ে গেল। লীজা স্পষ্টভাবে দেখতে পেল, দুটি অশ্বারোহী আগে আগে এগিয়ে যাচ্ছে আর তাদের পিছনে আরো আট-দশজন অশ্বারোহী। রূতাস বলল, অগ্রগামী দুই অশ্বারোহীর ডান পার্শ্বের ব্যক্তিটি খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আর বাম পার্শ্বের জনের নাম ইয়ায। তার পূর্ণ নাম আমি জানি না। সেও একজন সালার।
রূতাস বলল, এতো দূর থেকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এর চেহারা। স্পষ্টভাবে দেখতে পারবে না। নিকট থেকে দেখলে শত্রু হলেও মনে হবে, আল্লাহ তার চেহারায় এক অভাবনীয় প্রভাব লেপ্টে দিয়েছেন। যে কেউ তাকে দেখলে প্রভাবিত না হয়ে পারবে না। তার হৃদয়ের দীপ্তি আর উজ্জ্বল্য তার চেহারা দিয়ে ঠিকরে বেরুতে থাকে। তিনি এমন এক সালার যার জীবন কোষের পাতায় পরাজয় শব্দটি নেই।
লীজার কণ্ঠে ভীতির আভাস। বলল, আচ্ছা, তাহলে কি আলেপ্পাও তারা পদানত করে নিবে।
রূতাস বলল, আমি আপনার মনোবল ভাঙ্গব না। আমরা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করব। প্রয়োজনে আলেপ্পা রক্ষার জন্য আলেপ্পার মানুষ জীবন দিবে। দুর্গের ফটক খুলে আমরা সম্মুখ যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করব। রূতাস কি হতে পারে, কি হওয়া সম্ভব সবই একে একে লীজার নিকট বলতে লাগল। লীজা তার ডাগর চোখ জোড়া বাইরের দিক থেকে ফিরিয়ে এনে রূতাসের চেহারায় নিবদ্ধ করল। গভীর ও গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখল। বারবার আপাদমস্তক তাকে দেখল। তার অধর কোণে মধুর এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। অত্যন্ত বিমুগ্ধ, অত্যন্ত হৃদয় কাড়া সে দৃশ্য।
তারপর আর লীজা বেশী চিন্তা করতে পারেনি। রূতাসের বাহু ধরে তাকে নগর প্রাচীরের উঁচু স্থান থেকে নিয়ে এল। রূতাস সুবোধ বাধ্যগত পুরুষের ন্যায় তার সাথে চলতে লাগল।
***
আন্তোনীস, ইউকেলিসের মত রূতাসও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময় কাটাচ্ছে। সেও একজন সালার। বয়স পঁয়ত্রিশ ও চল্লিশের মধ্যে। দেখতে সুশ্রী, চিত্তাকর্ষী। লীজা থেকে তিন চার বৎসরের ছোট। শাহী পরিবারের সন্তান। সাম্রাজ্যের উঁচু পদে কর্মরত ছিল। বয়সে লীজার চেয়ে ছোট হলেও দেখতে লীজার চেয়ে বড় মনে হয়। শাহী খান্দানের সন্তান বলে লীজা রূতাসকে সম্মান করে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের স্ত্রী হওয়ার কারণেও সেও তাকে সম্মান করে।
রূতাস বাইরের দিকে তাকিয়ে লীজাকে বলল, ঐ তো দেখুন, একদল অশ্বারোহী যোদ্ধা চলে যাচ্ছে। হতে পারে একদলের পরিবর্তে আরেক দল আসছে। কিন্তু … কিন্তু আমার মনে হচ্ছে মুসলমানরা ধীরে ধীরে অবরোধ তুলে নিবে।
প্রায় এক হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদ খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর নির্দেশে অবরোধ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে। রাতাস ও লীজা অপলক নয়নে দেখছে, অশ্বারোহী দলটি ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। যেতে যেতে তারা দূরের এক পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল। লীজা রাতাসের দিকে ফিরে তাকাল। দেখল, রূতাসের চেহারায় এক বিমল আনন্দ খেলা করছে। তাকে আগের চেয়ে আরো সুশ্রী মোহময় মনে হচ্ছে। রূতাস ও লীজার মাঝে কোন লৌকিকতা ছিল না। অবরোধ শুরু হওয়ার পর প্রায়ই সে লীজার ঘরে যেত। তবে যখন ঘরে আন্তোনীস থাকে তখন সে কথাবার্তা ও আচার-আচরণে এ কথা বুঝায় যে, সে লীজার নিকট আসে নি। আন্তোনীসের নিকট এসেছে। তারই সাক্ষাৎ প্রার্থী।
লীজার কণ্ঠে বন্ধুসুলভ আবেদন ফুটে উঠল। বলল, রূতাস! একাকী থাকতে থাকতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। শহরের সাধারণ নারীদের সাথে তো আমি খোলামেলা মিশতে পরি না। আর তুমি তো জান আমি কেমন পরিবেশ থেকে এসেছি। আন্তোনীস দিন-রাত বাইরে থাকে। যখন ফিরে আসে তখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ফিরে আর বিছানায় পড়ে নাক ডেকে ঘুমায়। আমি আজ একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে কেল্লার পাঁচিলের নিকট চলে এসেছি। তোমাকে পেয়ে আমার কতো ভাল লাগছে! রূতাস তোমার সাথে যদি আমি তোমার ঘরে যাই তাহলে কি তুমি তা খারাপ মনে করবে?