***
পরদিন সকালে সূর্য বেশ উপরে উঠে যাওয়ার পর লীজার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলেই দেখে চারদিক আলো ঝলমল। জানলা গলিয়ে সূর্যের যে আলো ঘরে এসেছিল তা এখন বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে সে সবগুলো কক্ষ ঘুরে দেখল, যেন খাঁ খাঁ করছে। প্রত্যহ সকালেই এমন হয়। কিন্তু আজ সকালের এই একাকিত্ব তার হৃদয়ে যেন কাঁটা হয়ে বিধছে। পরিচারিকা এসে নাস্তা রেখে গেছে। ধূমায়িত খাবার। সুগন্ধে চারদিক মৌ মৌ করছে। লীজা নাস্তা খেতে বসল। অদূরে পরিচারিকাটি নির্দেশের অপেক্ষায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর পরিচারিকাটি ভীত কণ্ঠে বলল, রাণী মাতাজী! ঈশ্বর আপনাকে আরো মর্যাদাবান করুন। আমরা গরীব মানুষ। কবে অবরোধ উঠে যাবে জানলে মনটা আনন্দিত হয়। আপনি হয়তো জানেন না শহরে তরী তরকারির অভাব দেখা দিয়েছে। পানি তো যথেষ্ট আছে। কিন্তু শুধু পানি দ্বারা তো আর জীবন চলে না।
লীজার কণ্ঠ গম্ভীর। বলল, দিশেহারা হয়ো না। ভয়ও পেয়ো না। শীঘ্রই অবরোধ উঠে যাবে। যদি তা না হয় তাহলে আমাদের যোদ্ধারা বাইরে বেরিয়ে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করবে।
পরিচারিকাটি বিনীত কণ্ঠে বলল, রাণী মাতাজী! আপনাকে তো গীর্জায় কখনো দেখলাম না। গীর্জায় প্রত্যহ আমাদের বিজয় আর মুসলমানদের পরাজয়ের জন্য দুআ করা হয়। পাদ্রীরা বলেন, পাপ থেকে তওবা কর। আমাদের পাপের কারণেই এ বিরাট আযাব আমাদের উপর আপতিত হয়েছে। রাণী মাতাজী! আমরা গরীব মানুষ। আমরা আবার কি পাপ করলাম!
পারিচারিকার কথা পূর্ণ না হতেই লীজা হেসে ফেলল। পরিচারিকা কথা বন্ধ করে বিস্ময় বিমোহিত দৃষ্টিতে লীজার চেহারার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর পরিচারিকা বলল, শহরের লোকেরা বলছে, কেল্লার বাইরে গিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করা হবে। কিন্তু কিছু লোক বলছে, আক্রমণ না করে মুসলমানদের সাথে চুক্তি-পরামর্শ করে নগর প্রাচীর খুলে দেয়া উচিত। তারা বলছে, মুসলমানরা অত্যন্ত ন্যায় পরায়ণ জাতি। বিজিত শহরের লোকদের সাথে তারা অত্যন্ত ভাল আচরণ করে। কখনো কারোর উপর যুলুম অত্যাচার করে না।
লীজার হাসি যেন এবার নতুন প্রাণ পেল। কিন্তু পরিচারিকার কথায় সে কোন ভ্রূক্ষেপই করল না। নির্বিকার থেকেই তার কথাগুলো শুনল। আজকে লীজা একটু দ্রুত নাস্তা সেরে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।
শহরের ভিতরে থেকেও অবরোধের হট্টগোল শোনা যায়। যে সব লোক শহর রক্ষার জন্য নগর প্রাচীরে দাঁড়িয়ে আছে তারা বার বার আনন্দ ধ্বনি দিচ্ছে আর মুসলমানদের ব্যঙ্গ করে আক্রমণের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তাদের অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় তারা এখনো অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল, অসম্ভব উৎসাহী ও বিজয়ে আশাবাদী। লীজা ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কোন জায়গায় পৌঁছার লক্ষ্যে সে যাচ্ছে না। নয়ন তাকে যেদিকে পথ দেখাচ্ছে সেদিকেই সে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের মেয়েরা তাকে চিনে যে, সে তাদের সিপাহসালারের স্ত্রী। কিছুদূর অগ্রসর হলে, বেশ কিছু মহিলা তাকে ঘিরে ধরল। তাদের চেহারায় ভয় ও আতঙ্কের সুস্পষ্ট ছাপ। তারা জিজ্ঞেস করল, আর কতোদিন এ অবরোধ চলবে? দীর্ঘদিন কি এ অবরোধ চলতে থাকবে?
লীজা এক নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে যেন সজাগ হয়ে উঠল। মহিলাদের সাহস দিল। উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলল। অভয় দিয়ে বলল, অবরোধ বেশী দীর্ঘ হতে দেয়া হবে না। অতি শীঘ্রই কেল্লার বাইরে গিয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করা হবে। সুতরাং আমরা নারী হলে কি হবে, আমাদেরও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমাদেরও অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
লীজার উৎসাহব্যঞ্জক কথায় মহিলারা বেশ মুগ্ধ হল। তাদের চোখ-মুখের আতঙ্ক ভাব দূর হয়ে গেল। কেউ কেউ বলল, আমরা পুরুষদের মত বীর বীক্রমে যুদ্ধ করব। কিছুতেই মুসলমানদের জয়ী হতে দেব না।
লীজার মনের দুর্ভাবনা সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল। আরো সামনে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ চলার পর নগর প্রাচীরে গিয়ে পৌঁছল। প্রাচীরটি এতো প্রশস্থ যে একসাথে পাশাপাশি চারজন ব্যক্তি অনায়াসে চলতে পারে। কিন্তু তখন প্রাচীরের উপর দিয়ে চলা মুশকিল। কারণ শহরের প্রায় সকল লোক এসে প্রাচীরে উপস্থিত হয়েছে। এদিক সেদিক যাতায়াত করছে। এ ভীড়ের মাঝে পথ করে করে লীজা এগিয়ে চলছে। তাকে যারা চিনে তারা তাকে দেখেই কুর্নিশ করে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। লীজা যখন ভীড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন কাঁধের উপর যেন কার হস্তস্পর্শ অনুভব করল।
লীজার চলার গতি থেমে গেল। পশ্চাতে দৃষ্টি ফেলে দেখে, রূতাস দাঁড়িয়ে আছে। লীজার চেহারা আলোকময় হয়ে উঠল। রূতাসকে জিজ্ঞেস করল, যুদ্ধের পরিস্থিতি এখন কেমন? অবরোধ ভেঙ্গে ফেলা কি সম্ভব? না এখনো আমরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছি?
রূতাসের কণ্ঠ একেবারে শুষ্ক। বলল, আমরা তো মুসলমানদের অবরোধ প্রতিহত করে যাচ্ছি। তবে কোন ভয় নেই, কোন আতঙ্ক নেই সে কথা বলা আত্মপ্রবঞ্চনা মনে করছি।
মুসলমানদের সিপাহসালার হল খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)। আপনার হয়তো জানা নাও থাকতে পারে যে, আমি রোমান সম্রাটের গোয়েন্দা বিভাগের একজন উঁচু শ্রেণীর অফিসার ছিলাম। আমি ছদ্মবেশে মুসলমানদের তাঁবুতে গিয়েছিলাম। অতি নিকট থেকে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-কে দেখেছিলাম। এ সিপাহ সালারের কারণেই শাম থেকে আমাদের পালিয়ে যেতে হয়েছে। সে আমাদের প্রত্যাক্রমণেরও সুযোগ দেয়নি।