এক রাত আন্তোনীস বাড়িতে এসে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। শুয়ে পড়ল। লীজা এগিয়ে এল। মনে হচ্ছে, সে আন্তোনীসের সাথে কিছু কথা বলবে। কিন্তু আন্তোনীসের সে দিকে খেয়াল নেই। দুচারটি কথা বলেই আন্তোনীস অবরোধের আলোচনা শুরু করল। সাথে সাথে লীজার চেহারায় বিরক্তির সুস্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল। বুঝা গেল, সে আন্তোনীসের এই কথায় কোন আগ্রহ অনুভব করছে না।
তিক্ততায় ভরা কণ্ঠে লীজা বলল, আচ্ছা আন্তোনীস! তুমি কি আমার সাথে অন্য কোন কথা বলতে পার না!
আন্তোনীস উঠে বিছানায় বসল। বলল, লীজা! তুমি একথা বলছো! আমি তো এ ধারণা রাখি যে, আমি বাড়িতে এলে সবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, এখন অবরোধের পরিস্থিতি কেমন? অবরোধ কখন শেষ হবে? অবরোধ ভেঙ্গে ফেলার কোন পথ কি বের হয়েছে? এখন যা বললে তাতে মনে হয়, আমরা অত্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় আছি। অথচ আমি আমার মনে অন্য কোন চিন্তাকে আশ্রয় দিতে পারছি না।
লীজার অবস্থা স্বাভাবিক হল না। বরং আন্তোনীসের কথায় তার চেহারায় আরো বিরক্তি ও অসন্তোষের ভাব ছড়িয়ে পড়ল।
আন্তোনীস এবার লীজার চেহারায় সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে দেখল, লীজার চেহারায় অন্য ধরনের এক নেশা, তার অবয়বে ভিন্ন প্রকৃতির এক মোহের আলামত নৃত্য করছে। আন্তোনীস তার এই নেশা ও মোহের দাবী ও চাহিদা সম্পর্কে জ্ঞাত। তাদের মধ্যকার অবস্থা তো নির্মল প্রেম ও ভালবাসায় উজ্জীবিত এক প্রাণ এক দেহের মত নয়। যৌবনের ক্ষুধা নিবারণের জন্যই লীজা তার জীবনাকাশে আন্তোনীসকে টেনে এনেছে। তাই তার দাবী ও চাহিদা স্পষ্ট।
আন্তোনীস বলল, লীজা! আমাদের অবস্থার কথা একটু ভেবে দেখ। এ সময়। কিন্তু মজে থাকার কথা নয়। আমরা যদি এ যুদ্ধে হেরে যাই তাহলে আমাদের কোন আশ্রয় থাকবে না। আমরা এখান থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিব। বনু তাগলিবের মত যোদ্ধা ও শক্তিশালী কবিলাও বাধ্য হয়ে মুসলমানদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিন্তু তোমারও দায়িত্ব আছে। তোমারও ঘর থেকে বেরিয়ে কেল্লার ভিতরের মহিলাদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলা দরকার। প্রয়োজনে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে। মনে রাখবে, জীবন দিয়ে হলেও এ যুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মাল্য ছিনিয়ে আনতেই হবে।
তবুও আন্তোনীস লীজাকে তার মনের আবেগ, ইচ্ছা, প্রতিজ্ঞা ও পরিকল্পনার কথা বুঝতে পারল না। কারণ লীজা তার সাথে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তা শুধুমাত্র দৈহিক সুখানুভূতির মাঝেই সীমিত ছিল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস লীজাকে তার হেরেমে ফেলে রাখার পর লীজা তার যৌবন ক্ষুধা নিবারণের জন্য যাকে পেতো তাকেই গ্রহণ করত। আন্তোনীসকেই সে তখন অতি নিকটে পেয়েছিল। তাই তাকেই এ কাজের জন্য গ্রহণ করেছিল। উভয়ের এই মিলনের ফলশ্রুতিতে ইউকেলিসের আগমন হয়েছিল। এখন তো ইউকেলিসও তাকে পিতা হিসাবে বরণ করে নিয়েছে।
রাজা-বাদশাহদের স্ত্রী পরিজনের মাঝে সাধারণত জাতীয় কল্যাণ অকল্যাণের চিন্তা থাকে না। কোন দেশ বা অঞ্চলের সাথে তাদের হৃদয়েরও কোন টান থাকে না। তারা জীবনের উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে সর্বদা এ পরিণতির জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে যে, অন্য কোন রাজা হয়তো আক্রমণ করে তাদের দেশকে পদানত করে নিবে। তারপর তাদেরকে বন্দি করে নিয়ে তাদের আনন্দ উল্লাস আর বিনোদন সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করবে। অথবা কোন সালার বা রাজকুমার তাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে স্বপ্নের আকাশে উড়ে যাবে। তখন কারো কিছু বলার অধিকারও থাকবে না। তাই হেরেমের নারীদের বিজয়-পরাজয় আর উত্থান-পতনের সাথে কোনই সম্পর্ক নেই।
লীজার মানসিক অবস্থাও ঠিক তেমনি। আলেপ্পার বিজয় বা পরাজয় তার মূখ্য বিষয় নয়। আন্তোনীসের সাহচর্যই তার বেশী প্রয়োজন। সে একথাও ভেবে দেখেনি যে, আন্তোনীসও তো তার ব্যাপারে নিস্পৃহ ও আগ্রহহীন হয়ে যেতে পারে। আজকাল লীজা তাকে আকর্ষণ করার কিছু চেষ্টা করলেও আন্তোনীস থাকে অন্য চিন্তায় বিভোর। তার এখন লীজার সাথে হাস্যরস করার সুযোগ কই।
লীজার কথায় নৈরাশ্য ভাব ফুটে উঠল। বলল, তুমি তো এখনো তোমার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আছ। কবে তা হবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। কিন্তু এখনই তোমার আচার-আচরণ সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মত হয়ে উঠেছে। আমার পাশে বসে তুমি এখন আর কথা বলার ফুরসুতটুকুও পাও না।
আন্তোনীস অত্যন্ত ক্লান্ত। হাত পা যেন এখন আর তার চলে না। তাছাড়া আলেপ্পার বিজয় আর মুসলমানদের পরাজয়ের চিন্তা ভাবনায় তার মাথা আগুন হয়ে আছে। কিভাবে মুসলমানদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করবে এ চিন্তাই সারাক্ষণ তার মাথায় ভনভন করছে। লীজা তাকে যে উদ্দেশ্যের জন্য আহ্বান করছে আন্তোনীস তার সে আহ্বানে সাড়া দিল না। বরং শ্রান্ত দেহ নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল। মৃত ব্যক্তির ন্যায় তার দেহটি বিছানায় পড়ে রইল। লীজা এগিয়ে এসে তার ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইল। যেন একটি ফোয়ারা হঠাৎ শুকিয়ে মরে গেছে।
এ সময়ে লীজার অন্তরে ইউকেলিসের কথাও মনে পড়ে গেল। যাকে বুকের মাঝে রেখে রেখে সে জীবন কাটিয়ে দিল। যার জন্য নিজের জীবনকে নিংড়ে নিংড়ে শেষ করে দিল সেও তার দিকে এখন বেশি লক্ষ্য রাখছে না। দুই দুই তিন তিন রাত সে ঘরে আসে না। কখনো কিছু সময়ের জন্য এলেও কিছু আশার। কথা শুনিয়ে আবার ছুটে বেরিয়ে যায়। আন্তোনীস বলে, সে ঈসা মসীহ-এর রাজত্ব কায়েম করবে। কিন্তু ইউকেলিসের সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে ও কুসতুনতীনকে নিজ হাতে হত্যা করার প্রতি বেশী আকর্ষণ। লীজা কখনো ইউকেলিসকে নিজের কাছে রেখে যুদ্ধে নিহত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা করেনি। তার এখন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন আন্তোনীসের! আর আন্তোনীসও যেন তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে।