আব্দুল্লাহ অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত পাঁচশত ঘোড় সোওয়ার ও দেড় হাজার পায়দল বাহিনী নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
যখন মেরিদা শহরে বড় গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠল এবং মুসলমানদের ক্যাম্পে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজান-ধ্বনে ধ্বনিত হল তখন আব্দুল্লাহ তার বাহিনী নিয়ে যেখানে মাল বোঝায় কিন্তী পৌঁছে সেখানে উপস্থিত হল। আবদুল্লাহ তার সৈন্যবাহিনীকে বিন্যস্ত করে দিল। পুব দিগন্তে প্রভাত রবি উঁকি মেরে উঠল।
স্পেনীদের যে দু’জন ফৌজী অফিসার কিসতীর খবর নিতে এসেছিল তারা সকাল হবার পরও ফিরে না যাবার দরুন তার খোঁজে আরেক জনকে পাঠান হলো। এ ব্যক্তি ঘোড় সোয়ার ছিল। সে যখন নদীর পাড়ে পৌঁছল তখন তার কাঁধে একটা তীর বিদ্ধ হলো। সে তাৎক্ষণিকভাবে দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে ফিরে গেল। ফিরে গিয়ে খবর দিল ঘাট মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে।
তার সংবাদ মুতাবেক একটা ঘোড় সোয়ার বাহিনী প্রেরণ করা হলো। এ বাহিনী পাহাড়ী এলাকা ছেড়ে নদী পাড়ে পৌঁছা মাত্র তাদের ওপর তীর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তীর বিদ্ধ হয়ে পলায়ন করা ছাড়া তাদের আর কিছু করার ছিল না।
রাত্রে চারটি বড় বড় কিসতী এসে ঘাটে ভিড়লে মুসলমানরা তা কজা করে নিল। এক কিসতী মেষ-বকরীতে পূর্ণ। বাকী গুলোতে আটা-মাখন, ঘি, ডাল, তরিতরকারী ও শরাবের ড্রামের স্তূপ। আব্দুল্লাহর হুকুমে শরাবের ভ্রামগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হলো। মুসাকে সংবাদ দেয়া হলো বাকী সামান ক্যাম্পে নিয়ে যাবার জন্যে।
সাত-আট দিনের মাঝেই শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো তাদের শরাবের জন্যে। খানা-পিনার অভাবে মানুষ শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু শরাব পানকারী যদি শরাব না পায় তাহলে সে পাগলা কুকুরের মত হয়ে যায়। শহরের ফৌজ ও সাধারণ জনগণের অবস্থাও ঠিক এমনই হয়ে পড়েছিল। তারা পরস্পরে মারামারি, হানাহানিতে জড়িয়ে পড়েছিল। তাদের লড়াই এর স্পৃহা ক্রমে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
স্পেনী ফৌজরা ঘাট দখলে আনার জন্যে দ্বিতীয়বার হামলা করল কিন্তু মুসা তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এত মজবুত করে ছিলেন যে, তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। তৃতীয়বার আর চেষ্টা করল না।
***
রাজিলী : ইঞ্জেলা! বল, এখন কি তুমি ফৌজের মাঝে স্পৃহা-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারবে।
ইঞ্জেলা, হ্যাঁ এটা আমি জানি যে, শক্তিশালী দুশমনের মুকাবালা করা যায় কিন্তু ক্ষুধা-ক্লিষ্টের মুকাবালা শক্তিশালী দুশমনও করতে পারে না। তবুও আমি আগের মত মানুষের মাঝে উৎসা-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্যে চেষ্টা করব।
রাজিলী : বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য কর ইঞ্জেলা! সকলে ক্ষুধার্ত। আমি অনেক চিন্তা-ফিকির করে দেখলাম, এখন আর মেরীদাকে রক্ষা করা সম্ভবপর নয়। ক্ষুধার্ত, প্রজারা বিদ্রোহ শুরু করেছে। ফৌজরা শব চাচ্ছে। জনগণকে ভুখা রেখে ফৌজের পেট ভরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এর ফল এই দাঁড়াচ্ছে যে, তারা এখন ফৌজদের ভাল নজরে দেখছেনা। আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, চল আমরা রাত্রে এখান থেকে চলে যাই। আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি শহরের ফটক রাত্রে আমাদের জন্যে খোলা থাকবে।
ইঞ্জেলা : যাবে কোথায়? এমন কোন শহর কি আছে যা মুসলমানরা হস্তগত করেনি?
রাজিলী : আমি তোমাকে ফ্রান্স নিয়ে যাব।
ইঞ্জেলা : না, আমি এখনই যাব না।
রাজিলী : তাহলে তুমি কি জান পরিণাম কি হবে? মুসলমানদের সিপাহসালার বা অন্য কোন সালার তোমাকে তার দাসীতে পরিণত করবে। আর তুমি রানী হবার স্বপ্ন দেখছ। চল এখনই সময়। আমরা এখান থেকে চলে যাই। ফ্রান্স গিয়ে আমরা শাদী করে সেখানে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করব। যে পরিমাণ ধন-দৌলত আমি সাথে নিচ্ছি তা দেখে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে।
ইঞ্জেলা মুচকি হাসল।
রাজিলী : তুমি কি কোন জবাব দেবে না?
ইঞ্জেলা : দু’তিন দিন অপেক্ষা কর।
সকাল বেলা ইঞ্জেলা ঘোড়ায় সোয়ার হয়ে শহরে বেরুলে শহরবাসী তাকে ঘিরে ধরল। কিছুদিন পূর্বেও সে মানুষের কাছে গেলে তারা তার আগমনে জয়ের ধ্বনী তুলত। আর আজ তাকে বিদ্ধ হতে হচ্ছে নানা প্রশ্নবানে।
“ফৌজ বাহিরে কি করছে?”
“ফৌজরা হামলা করে অবরোধ কেন ভাঙছে না?”
“আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে ক্ষুধার্ত রেখে ফৌজের উদর পূর্তি করছি।”
“আমরা ভুখা, খাদ্য সংগ্রহ করে দাও, লড়াই করব।”
এ ধরনের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে জায়গায় জায়গায় হতে হলো। সে জেনারেলদের কাছে গেলে তারা তাকে বলল, ফৌজের খাদ্য শেষ হয়ে গেছে, তারা ঘোড়া জবাই করে খাওয়া শুরু করেছে। রাজিলীকে বল, শহর মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দিক।
ইঞ্জেলা রাজিলীর কাছে গিয়ে বলল, তুমি শহরের ফটক খুলে দেয়ার নির্দেশ দাও। কিন্তু এতে রাজিলী সম্মত হলো না।
ইঞ্জেলা : তুমি কি ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চাচ্ছ? মুসলমানরা যখন জানতে পারবে আমাদের ফৌজ ক্ষুধার্ত, লড়াই করার কাবেল নয় তখন তারা হামলা করে শহরে প্রবেশ করে লুটতরাজ করবে, যুবতী লাড়কীদেরকে নিজেদের মন মতো ব্যবহার করবে আর শহরবাসীকে করবে ব্যাপকভাবে হত্যা।
ঐতিহাসিকরা লেখেন তারপর এক জেনারেল চারজন ফৌজসহ সফেদ ঝান্ডা নিয়ে কেল্লা হতে বেরুলেন। মুসা তা দেখে দু’জন সালার ও দোভাষীকে সাথে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে স্পেনী জেনারেলের সাথে করমর্দন করলেন।