রডারিক তার মহলে যেসব রমণীদেরকে রেখেছিল তারা প্রত্যেকে একে অপরের চেয়ে ছিল সুন্দরী, কিন্তু ইঞ্জেলা এত বেশী সুন্দরী ছিল যে সাধারণত মহিলাদের মাঝে এমন দেখা যায় না। সে ছিল অদ্বিতীয়।
সে তো সুন্দরী ছিলই অধিকন্তু তার কথা-বার্তা ও চাল-চলনের মাঝে এমন আকর্ষণ ছিল যে সকলের মন-হৃদয় মুহূর্তের মাঝে জয় করে নিত। সদা তার ঠোঁটে থাকতো মুচকী হাসি। সে মুখে যা বলত তার চেয়ে অনেকগুণে বেশী বলত নয়ন যুগলে। রাজিলী পূর্ব হতেই এ রমণীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। রডারিকের মৃত্যু খবর পাওয়া মাত্র সে টলেডোতে এসে ইঞ্জেলাকে বলেছিল,
“এখানে তোমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সিংহাসনের দাবীদার রজমাত। আর তার মা হলো একচ্ছত্র রানীর দাবীদার। অন্যান্য বিবিদেরও সন্তান রয়েছে তারাও দাবীদার। আমি শুনতে পেলাম তোমার ব্যাপারে তারা অভিযোগ তুলেছে তুমি বিভিন্ন জেনারেলদের সাথে আতায়াত করে নাকি তখত দখল করতে চাচ্ছ। আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি তুমি এখান থেকে অতি তাড়াতাড়ি অন্যত্র চলে যাও।”
ইঞ্জেলা : কোথায় যাব?
আমার সাথে মেরীদা চল।
সেখানে গিয়ে আমি কি করব? সেখানে আমার অবস্থানই বা হবে কি?
রডারিকের মৃত্যুর পর স্পেনের তখত হয়েছে চূর্ণ-বিচূর্ণ। মুসলমানরা দ্রুত টলেডোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। মেরীদার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুবই মজবুত। আমরা সেখানে আমাদের হুকুমত কায়েম করব। তুমি সব ধরনের চিন্তা বাদ দিয়ে আমার সাথে চল। তোমার অন্য কোন অভিপ্রায় থাকলে তা পরিত্যাগ কর।
পরের দিন সকালে বিপুল পরিমাণ মনি-মুক্তা, সোনা-দানা তার নিজস্ব দাস দাসীসহ এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মেরীদার দিকে রওনা হলো। সে কি নিয়ে গেল কি রেখে গেল ভার বিন্দুমাত্র কেউ কোন খোঁজ নিল না। সকলেই মনে করল একজন দাবীদার কমে গেল।
সেখানে পোঁছার অল্প কয়েক দিনের মাঝে ইঞ্জেলা সেখানে অন্যান্য জেনারেল ও হাকীমদের মন জয় করে ফেলল। প্রত্যেকেই ইঞ্জেলাকে নিজের মনে করতে লাগল।
রাজিলী : ইঞ্জেলা! এখানের প্রত্যেক জেনারেল ও হাকিম তোমার আশেক। তাদের সকলের ধারণা তুমি তাদের সাথে শাদী করবে।
ইঞ্জেলা : এটা কি আমার সফলতা না যে আমি আশেক তৈরী করতে পেরেছি। আর সকলেই খাব দেখা শুরু করেছে যে তারা আমার স্বামী হবে।
আমিও খাব দেখছিনা তো?
হৃদয় কাড়া মুচকি হেসে ইঞ্জেলা জবাব দিল, তুমি খাব দেখবে কেন? তুমি কি দেখছনা, তুমি ছাড়া তাদের মাঝে কে আমার কাবেল? তাদের মত বৃদ্ধদেরকে খাবেন্দ হিসেবে কবুল করব? তোমাকে আমি মেরীদার বাদশাহ্ বানাব আর আমি হবো তোমার রানী।
“তাহলে আমি কি বিশ্বাস রাখব যে তুমি কেবল আমার? আবেগে অভিভূত হয়ে রাজিলী জিজ্ঞেস করল।”
“তোমার ছাড়া আর কার? আমি রানী হতে চাই, তুমি কি আমাকে রানী বানাতে পারবে”
তুমি কি ফালতু প্রশ্ন করলে। তুমি ছাড়া রানী হবে কে!
তুমি কি খবর পেয়েছ গ্রানাডা ও কর্ডোভা মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে। আর মুসলমানদের আরেকটা ফৌজী দল স্পেন এসেছে?
“তা শুনেছি এবং আমার কাছে এ খবর পৌঁছে যে, সে নয়া ফৌজি দল আমাদের এ শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।”
তুমি কি মুসলমানদের হাত থেকে এ শহরকে রক্ষা করতে পারবে?
হ্যাঁ ইঞ্জেলা! আমি অবশ্যই তা পারব। মুসলমান ফৌজ এখানে মরার জন্যে এসেছে।
“এমন কথা টলেডোতেও শুনেছিলাম। কিন্তু জানতে পারলাম মুসলমান ফৌজ টলেডোকে অবরোধ করার জন্যে শহরে পৌঁছতেই শহরবাসী ফটক খুলে দিয়ে মুসলমানদেরকে স্বাগতম জানিয়েছে। তুমি কি এমন বীরত্ব দেখাতে পার যে এখানে সৈন্য বাহিনী তোমার নেতৃত্বে শহরের বাহিরে নিয়ে গিয়ে মুসলমানদের ওপর এমন আক্রমণ করবে যে তারা হয়তো পালিয়ে যাবে বা খতম হয়ে যাবে?”
তুমি অপেক্ষা কর, দেখ কি করি।
তুমিও দেখতে পাবে, আমি কিভাবে অন্তর-মন, আমার শরীর তাবৎ কিছু তোমার কাছে সমর্পণ করে তোমার রানী হয়ে যাই।
বস্তুত: ইঞ্জেলা সব জেনারেলদের সাথেই এমন কথা বলে পাগল বানিয়ে রেখেছিল।
***
“হামলাকারীরা আসছে”
“তৈরী হয়ে নাও”
“সতর্ক হয়ে যাও”।
এ আওয়াজ শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। মানুষের মাঝে হুলস্থুল শুরু হয়ে গেল। তবে সে হুলস্থূল ভয়-ভীতির কারণে নয়, নয় পলায়নের জন্যে। বরং তারা সকলে প্রস্তুত হচ্ছিল যুদ্ধের জন্যে।
বহুদিন ধরে তারা যুদ্ধের ট্রেনিং দিচ্ছিল। তীর-বর্শা তৈরি করছিল। ইঞ্জেলা আসার পরে স্পৃহা উদ্দীপনা আরো বেড়ে গিয়েছিল। ইঞ্জেলার কানে খবর পৌঁছা মাত্র উম্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে শহরের অলি-গলিতে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, “যারা হাতিয়ার সমার্পণ করে মুসলমানদের হাতে নিজেদের শহর তুলে দিয়ে গোলাম হয়েছে তারা বুজদিল আত্মমর্যাদাহীন। তারা তাদের বেটীদেরকে সোপর্দ করে দিয়েছে। তোমরাও তোমাদের বেটীদেরকে বর্বরদের হাতে অর্পণ করে দিবে?”
প্রত্যেক জায়গায় জনতা দল জবাব দিল, “না…, না, আমরা আমাদের ইজ্জত রক্ষার্থে জীবন বিলিয়ে দিব।”
“ভুলে যেওনা, এটা গ্রানাডা-কর্ডোভা নয়, এটা রেমীদা। এটা প্রধান ধর্মগুরুর শহর। আজ গীর্জার ইজ্জত তোমাদের হাতে। ক্রসের ইজ্জত-আব্রু তোমাদের কাছে। ক্রসে ঝুলানো ঈসা মসীহের পবিত্র আত্মা দেখছে তোমরা কি খৃস্টবাদ রক্ষার্থে জীবন বিলিয়ে দাও না কি নিজের জীবনকে বেশী মহব্বত কর। তোমরা যদি এখানে মুসলমানদেরকে পরাজিত করতে পার তাহলে যেসব শহর মুসলমানরা কজা করেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধারে তোমরা অগ্রসর হতে পারবে। স্পেন হতে মুসলমান বিতাড়িত করার সৌভাগ্য তোমাদের হবে। আর তোমরা যদি হীনমন্য হয়ে বসে থাক তাহলে তোমাদের ইবাদতগাহ্ মসজিদে পরিণত হবে। তোমাদের ইবাদত খানার এমন বেহুমতি থোক এটা কি তোমরা কামনা কর?