কুলসুম বলল, এরূপ ধারণা করা কি ভুল নয় আমিরুল মু’মিনীন! কেবল দু’জন বর্বরকে হত্যা করে পুরো রাজ্যের বিদ্রোহের আশংকা খতম করা যায় না। কুলসুম সুলায়মানের সাথে রোমান্টিক ও প্রেমপূর্ণ আচরণের মাঝে বলল, মুসাকে বন্দী করে আপনি বিপদের বড় আশংকা জন্ম দিয়েছেন।
সুলায়মান রোমান্টিক অবস্থায় লোলুপ দৃষ্টে কুলসুমের চেহারার প্রতি অপলক নয়নে চেয়ে ছিলেন। যেন তাকে যাদু গ্রাস করেছে।
কুলসুম বলল, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, মুসা যে তার ছেলে আব্দুল আজীজকে স্পেনের আমীর নিযুক্ত করে এসেছে? আব্দুল আজীজের কাছে হয়তো এ খবর পৌঁছে গেছে যে, তার বাবার ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তাকে আস্তে আস্তে মৃত্যুমুখে পতিত করা হচ্ছে। তারেক ইবনে যিয়াদ যাতে দামেস্কের বাহিরে না যেতে পারে সে ব্যাপারে আপনি হুকুমজারী করেছেন। তারেক ও আব্দুল আজীজ দু’জন। এক। স্পেনে আমাদের সৈন্যরা মুসা, তারেক ও আব্দুল আজীজকে মর্যাদাবান ও সম্মানের অধিকারী জ্ঞান করে।
“তুমি কি এটা বলতে চাচ্ছে যে, আব্দুল আজীজ আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে?
কুলসুম জবাব দিল, কেন করব না? সে তার বাবার বেইজ্জতির প্রতিশোধ অবশ্যই নিবে। তামাম ফৌজ তার সাথে রয়েছে, ফলে সে স্বাধীন রাজ্যের ঘোষণা দিতে পারে। আপনি হয়তো এটাও ভুলে গেছেন যে, অর্ধেকের চেয়ে বেশী ফৌজ বর্বর। বর্বররা এ দাবী অবশ্যই করতে পারে যে তারাই স্পেন বিজেতা। আজ আপনি দু’জন বর্বরকে শাস্তি দিয়েছেন, যে বর্বররা হজ্জ করতে এসেছে তারা তাদের সর্দারকে খোঁজ করতে করতে যে কোন ভাবে এক সময় জেনে যাবে আপনি তাদেরকে কোথায় পাঠিয়েছেন।
সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক বললেন, থামো, আমি তো আব্দুল আজীজ বিন মুসার কথা চিন্তাই করিনি, আমাকে তার ব্যাপারে ভাবতে দাও।
***
খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের চিন্তা-চেতনায় ছিল আত্মম্ভরিতা। তিনি ছিলেন ব্যক্তি কেন্দ্রিক। কুলসুমের সৌন্দর্য-মাধুর্য ও প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক সুলায়মানের সে আত্মম্ভরিতাকে আরো বাড়িয়ে ছিল। খেলাফতের মসনদে বসার কয়েক দিন পূর্বে কুলসুম তার বালাখানায় এসেছিল। কুলসুমকে সুলায়মানের একবন্ধু হাদিয়া হিসেবে পেশ করেছিল। কুলসুম পূর্ব হতেই পুরুষকে আয়ত্ত করার যাদুকরী কৌশল সম্পর্কে পূর্ণ অভিজ্ঞ ছিল, এ কারণে সে এসেই সুলায়মানকে নিজের করতলগত ও অন্যান্য নারীদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করেছিল।
কুলসুমের সৌন্দর্যের মাঝে যাদু ছিল বা সে যাদু কারিণী ছিল তা নয়, বস্তুত: কমজরী ছিল সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের। তিনি মদ ও নারীর প্রতি আসক্ত ছিলেন। উম্মতে মুহাম্মদীর দুর্ভাগ্য যে, তিনি খেলাফতের মসনদে আসীন হয়েছিলেন। তিনি তার যোগ্যতানুসারে খেলাফতকে বাদশাহী রংগে রঞ্জিত করে অন্যান্য বাদশাহদের মত হুকুমজারী করেছিলেন।
ইতিহাস ও বাস্তবতা এ কথার সাক্ষী দেয়, যে ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব ও বংশ গৌরবকে পিছে ফেলে নারীর ওপর সোয়ার হয়েছে সে কেবল নিজে ধ্বংস হয়নি বরং সে যদি তার গোত্রের সর্দার হয় তাহলে পুরো গোত্রকে ধ্বংস করে। আর সে যদি কোন দেশের প্রধান হয়, তাহলে গোটা দেশকে, পুরো মিল্লাতকে ধ্বংস করে দেয়।
কুলসুম সুলায়মানের বিবি ছিল, না তার মহলে সেবিকা ছিল এ ব্যাপারে ইতিহাস একেবারে নিশ্চুপ। তবে ইতিহাস এ ব্যাপারে অনেক ঘটনা বর্ণনা করে, যে ঘটনা সুলায়মানকে এক স্বৈরশাসক এবং জালেম বাদশাহ হিসেবে প্রমাণ করে। তার খেলাফত প্রকৃত অর্থে বাদশাহী ছিল। তিনি বাহ্যত হজ্জ পালনের জন্যে গিয়েছিলেন তবে বাদশাহী শান-শওকত সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। খলীফার দেহরক্ষী দল, গোয়েন্দা বাহিনীও সাথে ছিল। তিনি আল্লাহর ঘরে গিয়েও নিজের দরবার বসিয়েছিলেন।
সুলায়মান যে দিন বিকেলে দু’জন বর্বর সর্দারকে শাস্তি দিলেন সেদিন রাত্রে তিনি তার তাবু হতে বেরিয়ে দু’জন দেহ রক্ষি ও দু’জন মশালধারীকে সাথে নিয়ে মুসার শয়ন স্থলে গেলেন। মুসা শায়িত অবস্থায় ছিলেন।
সুলায়মান, মুসাকে লাথি মেরে বললেন, উঠ।
বৃদ্ধ-দুর্বল মুসা ইবনে নুসাইর অতি কণ্ঠে উঠে বসে উপরের দিকে লক্ষ্য করলেন।
সুলায়মান বললেন, “তোর বিবেক ঠিক হয়ে গেছে নাকি? ঐ দুই বর্বর বিদ্রোহের কথা বলছিল আর তুই নিষেধ করছিলি।”
তোমার ভয়ে নয় ইবনে আব্দুল মালেক। মুসা আসমানের দিকে ইশারা করে বললেন, আল্লাহর ভয়ে, এখনও আমার তোমার ও তোমার খেলাফতের কোন ভয় নেই।
সুলায়মান বিদ্রুপাত্তক অট্টহাসি হাসলেন। সুলায়মান বললেন, হতভাগা! তুই কি মনে করিস আমার কোন খোদাভীতি নেই।
মুসা বললেন, না। তুমি তো আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কেও জ্ঞাত নও। কুরআন খুলে দ্বিতীয় পারা পড়, আল্লাহর ফরমান “হজ্জের সময় সহবাস হতে দূরে থাক, মন্দ কাজ করিও না, কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়োনা, তোমরা যে সৎ কাজ করে তা আল্লাহ্ জ্ঞাত। হজ্জের সফরে পাথেয় সাথে নিয়ে যাও আর উত্তম। পাথেয় হলো আল্লাহভীতি। সুতরাং হে জ্ঞানী সম্প্রদায় আমার নাফরমানী করবে না।” তুমি কি এ বিধানের উপর আমল করছ? খলিফা সুলায়মান!
খলীফা সুলায়মান তাকে বাঁকা চোখে দেখে ফিরে গেলেন।
***
হজ্জ শেষ হলো। হাজীদের কাফেলা ফিরে চলেছে। খলীফা সুলায়মানের কাফেলাও দামেস্কের দিকে রওনা হয়ে গেল। মুসাকে প্রতিদিন সামান্য কিছু পথ .উটে চড়িয়ে নেয়া হতো বাকী সারা দিন পায়ে হেঁটে চলতে হতো।