***
খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেকের ভাই ছিলেন। তার পূর্বে খলীফা ছিলেন ওয়ালীদ। তিনি তার ছেলেকে নিজের স্থলাভিষিক্ত বানাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে তিনি এমন গুরুতর অসুস্থহয়ে পড়লেন যে কিছু দিনের মাঝেই তার ইন্তেকাল হয়ে গেল। ফলে খলীফা হিসেবে নিজের ছেলের নামটাও ঘোষণার অবকাশ পেলেন না। তার মৃত্যুরপরে খেলাফতের মসনদে সুলায়মান অধিষ্ঠিত হন।
দুই ভাইয়ের মাঝে পার্থক্য এই ছিল যে, ওয়ালীদ মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে হিন্দুস্থানে যুদ্ধের জন্যে প্রেরণ করে সৈন্য বাহিনীসহ যত ধরনের সাহায্য অব্যাহত রেখেছিলেন। অপর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার আমীর মুসা ইবনে নুসাইর যে আবেদন করেছিলেন, স্পেনের উপর হামলা করার এবং তার নেতৃত্ব বর্বর সিপাহসালার তারেক ইবনে যিয়াদকে দেয়ার জন্যে, ওয়ালীদ তার এ আবেদন কেবল মঞ্জুরই করেননি বরং স্পেন আক্রমণের অনুমতির সাথে সাথে সর্বোপরি সাহায্য প্রেরণ করেছেন।
ওয়ালীদের ভাই সুলায়মান খলীফা হয়ে মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে হিন্দুস্থান হতে সে সময় অপরাধী হিসেবে তলব করে বন্দীকরে হত্যা করেন। যখন সিন্দুকে ইসলামের পতাকাতলে এনে বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অপর দিকে মুসা ইবনে নুসাইরকে দামেস্কে ডেকে বন্দী করেছিলেন যখন মুসা তারেক ইবনে যিয়াদ এর পরে স্পেনে পৌঁছে ঐসব এলাকা বিজয় করছিলেন যে এলাকায় তারেক পৌঁছেন নি, সুলায়মান তারেককেও ফিরিয়ে এনেছিলেন।
যদি খলীফা ওয়ালীদের পুত্র খলীফা হত এবং তিনি যদি তার পিতার পদাংক অনুসরণ করতেন তাহলে ইউরোপ ও হিন্দুস্থানের ইতিহাস অন্য রকম হতো। সুলায়মান কুতায়বা বিন মুসলিমকেও বাধ্যবাধকতার শিকল পরিয়ে দেন। ঐতিহাসিকরা লেখেন, হিন্দুস্থান ও ইউরোপে মুসলিম সৈন্য বাহিনী প্রেরণ ও এ দু’দেশে ইসলামের বাণী পৌঁছানোর পিছনে কুতায়বা বিন মুসলিমের অবদান ও বড় ভূমিকা ছিল। কুতায়বা যখন চীনে ছিলেন তখন সুলায়মান তাকে দামেস্কে ফিরিয়ে আনেন।
***
মুসা ইবনে নুসাইর হজ্জের সময় মক্কায় ভিক্ষা করতে থাকেন। ভিক্ষা করে সারা দিনে তিনি যা পেতেন তা খলীফা সুলায়মানকে দিয়ে দিতেন।
পূর্ণ খোলা আকাশের নিচে মুসাকে বসিয়ে দেয়া হতো। একজন পাহারাদার তার কাছে উপস্থিত থাকত। তাকে কোন প্রকার খাবার দেয়া হত না। তিনি নিজের ভিক্ষার পয়সা হতে খাবার কিনে খেতেন। তিনি এক বছর ধরে দুর্বিসহ কষ্ঠভোগ করছিলেন। খলীফা সুলায়মান তার সারা গৌরব গাঁথা বিজয়ের কথা ভুলে তো গিয়ে ছিলেনই অধিকন্তু তার জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্রও পক্ষেপ করেননি। তিনি তো তার জীবনের আখিরী মঞ্জিলে পৌঁছে গিয়ে ছিলেন। খলীফা সুলায়মান কেবল মাত্র তার প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তাকে কেবল বন্দীশালাতেই নিক্ষেপ করেননি বরং তাকে মানষিক নির্যাতন করে তার বৃদ্ধ শরীরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেছিলেন। প্রচণ্ড রোদ্রের মাঝে তপ্তবালুর উপর মুসাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হত। যখন তিনি বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন তখন তার মুখে কয়েকফোঁটা পানি দেয়া হতো যাতে তিনি জীবিত থাকেন। জীবিত রাখার জন্যেই কেবল মাত্র তাকে যৎ সামান্য খাবার দেয়া হতো।
মুসা ইবনে নুসাইরকে প্রথমে খলীফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক বিশেষ– কোন উদ্দেশ্যে স্পেন হতে ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য যখন তিনি দামেস্কে ফিরে এসেছিলেন তখন ওয়ালীদ শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি সুলায়মানের হাতে বন্দী হন। সুলায়মান তার ওপর বিভিন্ন অভিযোগ আরোপ করে অত্যন্ত লোমহর্ষকভাবে তার ওপর নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে দু’লক্ষ দিনার জরিমানা চালিয়ে তাকে একথা বলে মক্কাতে নেয়া হয়ে ছিল যে ভিক্ষা করে টাকা পরিশোধ কর।
***
খলীফার ইঙ্গিতে যখন খিজির ও ইউসুফকে টেনে-হেঁছড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হল তখন খলীফার তাবুর সাথে ঝুলান যে পর্দা ছিল তা সরিয়ে এক অপরূপ সুন্দরী রমণী সম্মুখে আসল। সে সিরিয়া অঞ্চলের সৌন্দর্যের রাণী ছিল। রমণী এসে সুলায়মানের পিছনে দাঁড়াল। সে তার হাত সুলায়মানের কাঁধে রেখে তার ঘাড়ে আঙ্গুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। সুলায়মান তার হাতের মাঝে রমণীর হাত নিয়ে নিলেন।
সুলায়মান মৃদু সুরে আহ্বান করলেন, “কুলসুম!”
কুলসুম তখনও ছিল পূর্ণ যৌবনা যুবতী, সে সুলায়মানের সামনে এসে তার উরুর ওপর বসে পড়ল।
তুমি কি শুনেছ আমি কি করেছি?
কুলসুম সুলায়মানের গোঁফের ওপর আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে বলল, হ্যাঁ আমিরুল মু’মিনীন! আমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।
সুলায়মান কুলসুমের কমর ধরে ব্যাঙাত্মক মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, হতভাগা বর্বর। আফ্রিকা হতে এত দূর আমার হুকুমে মরার জন্যে এসেছে। কত বড় দুঃসাহস! মুসাকে বাঁচানোর জন্যে বিদ্রোহের কথা বলছিল।
আপনি কি নিশ্চিত যে এখন আর কেউ আপনার রাজ্যে বিদ্রোহের কথা বলবে না? কুলসুম জিজ্ঞেস করল।
সুলায়মান বললেন, যে বলবে তার পরিণাম এ বর্বরদের মত হবে। মানুষ আমাকে জালিম বলবে, ঐতিহাসিকরা ইতিহাস লেখার সময় আমাকে নির্দয়, অত্যাচারী হিসেবে অবহিত করবে। কিন্তু আগত প্রজন্ম একথা শ্রবণ করবে না যে, আমার খেলাফতকালে কোথাও বিদ্রোহ হয়েছে।