ঐ নরম আরাম চেয়ারে আরবী পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি বসে ছিল। তার পোশাক এমন ছিল, যে কেউ দূর থেকে দেখেই বলতে পারত সে কোন দেশের বাদশাহ। এক ব্যক্তি কপালে হাত রেখে মাথানত করে তাকে সম্মান জানিয়ে বলল, খলীফাতুল মুসলিমীন! দু’জনকেই নিয়ে এসেছি। খলীফা জিজ্ঞেস করলেন, তাদের কাছে কি অস্ত্র আছে?
সে ব্যক্তি জবাব দিল না, খলীফাতুল মুসলিমীন! তদের কাছে কোন অস্ত্র নেই। তারা ইহরাম বাঁধা অবস্থায় আছে, তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েছি।
খলীফাতুল মুসলিমীন সুলায়মান বিন আব্দুল মালেক শাহী ভঙ্গিতে হালকা মাথা নাড়লেন, তার সম্মুখে দাঁড়ান ব্যক্তি চলে গেল।
বর্বর ইউসুফ ইবনে হারেছ ও খিজির ইবনে গিয়াস ভিতরে প্রবেশ করলেন, আসলামু আলাইকুম আমীরুল মু’মিনীন! দু’জন এক সাথে বলে উঠলেন। খলীফা বললেন, বর্বরদের ব্যাপারে যা শুনেছি তা দেখা যায় ভুল শুনেনি।
খিজির জিজ্ঞেস করলেন, খলীফা বর্বরদের ব্যাপারে কি শুনেছেন?
খলীফা বললেন, তারা সভ্যতার ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ, জংলী। তোমাদের চেয়ে আমাদের গ্রাম্যরা যারা সভ্যতা-সংস্কৃতি কিছু বুঝে না তারাও অনেক ভাল।
ইউসুফ-খিজিরের চেহারায় পেরেশানির ছাপ ফুটে উঠছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
খলীফা শাহী প্রতাপে বললেন, একে অপরের দিকে কি দেখছ? আমার দিকে লক্ষ্য কর। তোমরা একেবারে নিষ্পাপ, তোমাদেরকে খলীফার দরবারের আদব শিক্ষা দেয়া হয়নি। তোমাদেরকে বলা হয়নি যে খলীফার সামনে ঝুঁকে সালাম করতে হয়?
ইউসুফ বললেন, আমীরুল মু’মিনীন! আমরা তো কেবল সে দরবারে ফুঁকতে চাই, এত দূর হতে যার দরবারে হাজিরা দেয়ার জন্যে এসেছি। আল্লাহর দরবারে আমরা শুধু কেবল ঝুঁকেই পড়ি না বরং সেজদাও করি। এ আদব ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে।
এখন তোমরা খলীফাতুল মুসলিমীনের দরবারে আছে। খলীফা ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন, “এখানেও নত হওয়া জরুরী।”
ইউসুফ বললেন, খলীফাতুল মুসলিমীন! ইসলামের নিয়মনীতি আমাদের ভাল লেগেছিল তাই আমরা গ্রহণ করেছি। ইসলামের এটাও একটা বিধান- মানুষ মানুষের সামনে মাথা নত করে না, ইসলাম কেবল আল্লাহ্ তা’য়ালার সামনে মাথা নত করার নির্দেশ প্রদান করে। আপনি যদি আমাদেরকে আপনার সামনে মাথা নত করার নির্দেশ দেন তাহলে আমরা আমাদের ধর্মে ফিরে যাই।
“আমি ইসলামেরই খলীফা” সুলায়মান বললেন, ইসলামের কি বিধি-বিধান তা আমাকে বলতে হবে না, বন-বাদাড়ে বসবাসকারি, সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ বর্বর কেউ আমাকে ইসলামের বিধান শিক্ষা দেবে তার অনুমতি আমি আদৌ দিতে পারি না।
“বর্বরদের তাহযীব, আখলাক যদি দেখতে চান তাহলে স্পেনে গিয়ে দেখুন খলীফা। খিজির উত্তেজিত হয়ে বললেন,আপনি কি জানেন না স্পেন বিজয়ের অগ্রনায়ক বর্বররা। ইউসুফ বললেন, তারেক ইবনে যিয়াদও বর্বর, যে বর্বরদেরকে আপনি অশিক্ষিত ও জংলী বলেছেন, তারা স্পেনের কাফেরদের অন্তর জয় করে তাদেরকে ইসলামের শীতল ছায়া তলে এনেছে।”
খিজির বললেন, খলীফাতুল মুসলিমীন! বর্বর সিপাহ্ সালারের অধীনে আরব সৈন্যবাহিনী সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল এমন সময় আপনি স্পেন বিজয়ীদেকে ফিরিয়ে এনেছেন, তারেক ইবনে যিয়াদ স্পেন সাগর পাড়ে পৌঁছে তাবৎ নৌকা জ্বালিয়ে দিয়েছিল যাতে ফিরে আসার কোন রাস্তাই না থাকে। কিন্তু যখন সে অর্ধেক স্পেন বিজয় করে ফেলেছে তখন আপনি তাকে দামেস্কে ডেকে এনে তার চলার রাস্তা চির তরে বন্ধ করে দিলেন যাতে তার নাম ইতিহাসের পাতা হতে মুছে যায়। আর বিজয়ী, আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইরকে শিকল পরিয়ে ভিখারী বানিয়েছেন। স্পেনে গিয়ে দেখুন, ঐ বর্বররাই স্পেনের কেন্দ্রস্থলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন। করেছে।
খলীফা বললেন, শুনতে পেলাম তোমরা নাকি মুসার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার প্রতিশোধ আমার থেকে নিবে? আমাকে হত্যা করার ক্ষমতা কি তোমাদের রয়েছে? তোমরা নাকি বিদ্রোহ করে আমার খিলাফতের মসনদ তছনছ করে দিতে চাচ্ছ?
ইউসুফ বললেন, মুসা ইবনে নুসাইর যদি সামান্যতম ইঙ্গিতও প্রদান করেন তাহলে আমরা বিদ্রোহ করে দেখিয়ে দিতে পারি। আমরা মুসার সাথে সে আলোচনা করেছি। তা যদি আপনার চররা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে থাকে তাহলে আমরা তা অস্বীকার করব না। আপনার কানে কি এ কথা পৌঁছেনি, যে তিনি বলেছেন, বিদ্রোহের নামও মুখে আনবেনা তাহলে ইসলামী হুকুমত দূর্বল হয়ে পড়বে? কিন্তু আপনি তো এদিকে ইসলামের মুলোৎপাটন করছেন।
খলীফা গর্জে উঠে বললেন, নিয়ে যাও এ দু’তর্কবাজকে, তাদেরকে দামেস্কের বন্দিশালায় পাঠিয়ে দাও। ঐখানেই তাদের আখিরী ঠিকানা হবে। সাথে সাথে খলীফার ছয়-সাতজন ফৌজ দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করল, তাদের তলোয়ারের খোঁচা দুই বর্বরের শরীরে লাগতে লাগল। সৈন্যরা তাদেরকে জোরপূর্বক টেনে হেঁচড়ে তাবু থেকে বের করে নিয়ে গেল।
ইউসুফ ও খিজিরের আওয়াজ খলীফা শুনতে ছিলেন, “আমাদেরকে হজ্জ্ব পালনে বাধা প্রদানকারী। তোমার বাদশাহীর দিন বেশি দিন নেই। তাদের আওয়াজ আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসল এবং এক সময় হাজীদের সম্মিলিত ধ্বনি “আল্লাহুম্মা লাব্বাইকের নিচে চাপা পড়ে গেল। তারপর আর সে দু’ বর্বরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।