***
ঐ রাতেই আওপাস ফিরে এলো। সে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছিল। সে প্রথমে জুলিয়নের সাথে সাক্ষাৎ করল। জুলিয়ন তাকে তারেক ইবনে যিয়াদের তাবুতে নিয়ে গেল সেখানে অন্যান্য সালাররাও ছিলেন। আওপাস তার পুরো কার্যকর্মের কথা বর্ণনা করল। মেরীনার সাথে মুলাকাত ও তার সাথে যে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তাও নাল।
তারেক : তুমি কি বিশ্বাস কর যে, ঐ আওরত এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেবে?
আওপাস : তার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। যদি মেরীনা এ কাজ না করে তাহলে অন্যরা করবে। গোথা কওমের কয়েকজন সর্দার সেখানে মওজুদ ছিল তাদের সাথে আমি সাক্ষাৎ করে এসেছি।… তবে ইবনে যিয়াদ ভাল করে একথাটা শুনে নাও যে, রডারিক কমছে কম এক লাখ ফৌজ সাথে নিয়ে আসবে। পিমপুলনা থেকে টলেডো পর্যন্ত সকল লোক ফৌজে যোগ দিচ্ছে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : এটা তো আমার জন্যে সুসংবাদ। যদি সাধারণ জনগণ ফৌজে শামিল হয় তাহলে তারা ভিড় বাড়িয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ করবে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত অভিজ্ঞ ফৌজের মত লড়াই করতে পারবেনা। তারা যুদ্ধ নিয়ম-কানুন ও শৃংখলার ব্যাপারে অজ্ঞ হবে।
আবু জুরয়া তুরাইফ : তারপরও খুশী হয়ে অসচেতন থাকা আদৌ সমীচীন হবে না। আমাদের ফৌজ সংখ্যা কখনও তাদের সমপরিমাণ হবে না। আমাদের জন্যে যদি সাহায্য আসে তাহলে সে সৈন্য সংখ্যাও সাত হাজারের বেশী হবে না।
তারেক ইবনে যিয়াদ : আমি তোমাদের সকলকে একথা বলতে চাই যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদের বিজয়ের ব্যবস্থা করছেন, আওপাস টলেডোতে যা করে এসেছে তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার কুদরতি হাতে করেছেন।
***
আমীরে মিশর ও আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইর খলীফা ওয়ালীদকে তারেক ইবনে যিয়াদের প্রথম বিজয়ের সংবাদ পাঠিয়ে যে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন, তার জবাবে খলীফা সাহায্যের জন্যে পাঁচ হাজার ফৌজ পাঠিয়ে ছিলেন। সে পাঁচ হাজার ফৌজের মাঝে সোয়ারী কতজন ছিল আর পায়দল কত ছিল তার সংখ্যা কোন ইতিহাসেই বিস্তারিত পাওয়া যায় না। তবে এ বিষয়টা সকলেরই সামনে ছিল যে প্রয়োজনের তাগীদে ফৌজ সংখ্যা একেবারেই কম ছিল। তারেকের কাছে সাত হাজার ফৌজ ছিল যার মাঝে প্রথম যুদ্ধে কিছু শহীদ হয়েছিল। পরবর্তী সাহায্যের জন্যে প্রেরিত ফৌজ মিলিয়ে মোট ফৌজ হয় বার হাজার।
এদিকে রডারিকের এলান অনুপাতে মানুষ অত্যন্ত স্পৃহা-আগ্রহ নিয়ে দলে দলে ফৌজী বাহিনীতে শামিল হচ্ছিল। কয়েক দিনের মাঝেই রডারিকের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছে ছিল আর এ সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুশিররা (পরামর্শ দাতাগণ) বলেছিল, আক্রমণকারীদের সংখ্যা মাত্র সাত হাজার এত কম সংখ্যক ফৌজের মুকাবালায় এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য জমা করার কোন প্রয়োজন নেই। এতে একে তো সময় নষ্ট হচ্ছে অপর দিকে খরচ বাড়ছে।
রডারিক শাহী হুংকার দিয়ে বলল, তিতুমীর আক্রমণকারীদেরকে জিন-ভূত হিসেবে অবহিত করেছে, আমি লাখের বেশি ফৌজ নিয়ে যাব যাতে দুনিয়ার অন্য কওমও জানতে পারে যে, স্পেনের বাদশাহ্ কত শক্তিশালী। পরে তাদের দেমাগ থেকে স্পেনের ওপর আক্রমণের ভূত বেরিয়ে যাবে। আমি অসংখ্য ফৌজের মাধ্যমে আক্রমণকারীদের সাত হাজার ফৌজকে পদতলে পৃষ্ঠ করে মারব। বিশ পঁচিশ হাজার অশ্বারোহী তাদের ওপর দৌড়িয়ে আমি তাদের শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে কিমা বানাব। আমি জিন ভূতকে ভয় পাই না।
রডারিক যে একজন নির্ভীক বীর বাহাদূর লড়াকু ছিল ইতিহাস এ বাস্তবতা স্বীকার করে এবং সে যে জিন-ভূতকে ভয় পেতনী তাও প্রমাণ করে। তার নির্ভীকতা ও বীরত্ব এমন রূপ কথা জন্ম দিয়েছে যা ইতিহাসের একটা অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। আমেরিকার এক ঐতিহাসিক ডাশনকশন আওরং তার বই “স্পেনের বিজয়” এর মাঝে এ ঘটনা বিস্তারিত ভাবে লেখেছেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক লেইন পোল এ ঘটনা ড্রশনকশন ছাড়া পূর্বেকার দলীল দস্তাবেজ এর উদ্ধৃতি দিয়ে তার গ্রন্থ “মূর স্পেনে উল্লেখ করেছেন। (ইউরোপের ঐতিহাসিকরা বর্বর মুসলমানদেরকে মুর লেখেছেন)।
আরেকটি ঘটনা নিম্নরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, “তারেক ইবনে যিয়াদ’ স্পেন আক্রমণ করার কিছুদিন পূর্বে বাদশাহ্ রডারিক টলেডোতে তার দরবারে মসনদে বসে আছে, এমন সময় দু’জন সম্মানিত বৃদ্ধ দরবারে প্রবেশ করল। তারা পুরাতন যুগের আবা কাবা পরিহিত ছিল। তাদেরকে দেখে ধর্মগুরু বলে মনে হচ্ছিল। তাদের শুভ্র দাড়ি ও চাল-চলনে বলছিল তারা উঁচু পর্যায়ের গণক বা পাদ্রী। তারা তাদের কাপড় কোমরবন্দ দ্বারা কোমরের সাথে বেঁধে রেখে ছিল আর তাদের কোমর বন্দের সাথে ছিল চাবির বড় গোছা। রডারিকের মত দাম্ভিক বাদশাহও তাদের সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের মাঝ থেকে একজন হাতের ইশারায় রডারিককে বসার জন্যে ইশারা করলে রডারিক বসে পড়ল।
এক বৃদ্ধ বলল, হে শাহে উন্দুলুস! আমরা তোমাকে একটা গোপন কথা বলার জন্যে এসেছি। প্রত্যেক নতুন বাদশাহর জন্যেই জরুরী সে গোপন বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া। তুমি নতুন আসনাসীন হয়েছে এবং তোমার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
রডারিক : এ গোপন বিষয় সম্পর্কে আমি অবহিত হতে চাই না। আশা করি আর কোন ভূমিকার প্রয়োজন নেই।
বৃদ্ধ : বেশী অস্থির হয়ো না বাদশাহ্! গোপন বিষয় অবগত হবার পরেও ধৈর্য হারা হবে না। তা নাহলে পরে আফসোস করতে হবে। … যখন এ মূলকে হিরাক্লিয়াসের বাদশাহী ছিল তখন সে স্পেন প্রজন্মের জন্যে ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তারপর সে এ টলেডো শহরের বাহিরে একটা বুরুজ নির্মাণ করিয়ে ছিল। তার মাঝে সে কোন যাদু মন্ত্র রেখেছিল। ঐ বুরুজের একটাই লোহার দরজা যা অত্যন্ত শক্তিশালী মজবুত। দুরজাতে সে নিজ হাতে তালা লাগিয়ে ছিল। সে বলেছিল স্পেনের প্রত্যেক নব বাদশাহর জন্যে অপরিহার্য সে শাহী মসনদে বসার কিছু দিন পর এ দরজায় একটা তালা লাগিয়ে তার চাবি আমাদের কাছে অর্পণ করবে। বৃদ্ধ চাবির গোছা দেখিয়ে বলল,এগুলো ঐ তালার চাবি যা হিরাক্লিয়াসের পরেএবং তোমার পূর্বের বাদশাহরা লাগিয়ে ছিল। এবার তোমার পালা। দরজায় তালা লাগিয়ে দাও; আমরা একদিন এসে চাবি নিয়ে যাব।