ইউসুফ ইবনে হারেছ বললেন, আমীরে আফ্রিকা আপনি আমাদেরকে বলুন, আমরা আপনার জন্যে কি করতে পারি?
মুসা বললেন, তোমাদের কিছুই করার নেই, আল্লাহ হয়তো আমাকে কোন গুনাহের শাস্তি দিচ্ছেন।
খিজির ইবনে গিয়াস বললেন, কিছুতো আপনি বলেন, আমরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব।
ইউসুফ ইবনে হারেছ মুসার কানেকানে বললেন, আমরা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেককে হত্যা করতে পারি। সে হজ্জ পালন করতে এসেছে আর লাশ হয়ে ফিরে যাবে দামেস্কে।
তারপরে কি হবে? মুসা জিজ্ঞেস করলেন,
‘নতুন খলীফা আপনাকে মাফ করে দেবেন’ ইউসুফ বললেন, আমরা শুনেছি আপনি সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের ব্যক্তিগত ক্রোধ ও হিংসার পাত্রে পরিণত হয়েছেন।
মুসা বললেন, আমি যদি তাকে হত্যা করাই তাহলে আমিও আল্লাহর দরবারে ব্যক্তিগত আক্রোশের অপরাধে অপরাধী হব। আমি নিজেও তার খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাতে পারতাম কিন্তু বন্ধুরা! আমার কাছে আমার নিজের জীবনের চেয়ে ইসলামের মান-মর্যাদা অনেক বেশি। আমি এবং আমার পূর্বের আমীররা তোমাদের গোত্রের বিদ্রোহকে কেন খতম করেছিলেন? তোমাদেরকে নিজেদের গোলাম বানানোর জন্যে নয় বরং মুসলমানদের মাঝে একতা সৃষ্টি করা এবং কুফরের বিরুদ্ধে ইসলামকে একক শক্তি হিসেবে আত্ম প্রকাশ করানোর জন্যে। আমি আর কতদিনই বা জীবিত থাকব? আর কয়েকদিন সূর্য উদিত হতে দেখব। সুলায়মানইবা কত দিন জীবিত থাকবে? তাকেও তো মরতে হবে। ইসলামই কেবল জীবিত থাকবে। একবার যদি খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় তাহলে এ বিদ্রোহের আগুন প্রত্যেকটি মুসলিম রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আমি নিজেকে নয় ইসলামকে বাঁচাতে চাই।
যে সময় বর্বর ইউসুফ ইবনে হারেছ এবং খিজির ইবনে গিয়াস মুসা ইবনে নুসাইরের সাথে খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেককে হত্যা এবং তার খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা আলোচনা করছিলেন, সে সময় একজন হাজী এসে কাছে দাঁড়িয়ে তাদের কথা-বার্তা শুনছিল। ইউসুফ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি এ দুর্বল ভিক্ষুকের তামাশা দেখছ? যদি কিছু দিতে চাও তাহলে দিয়ে চলে যাও।
সে ব্যক্তি বলল, ভিখারী ও তোমাদের কথা-বার্তা শুনছি ভাই! এর দুঃখে আমার অন্তর জ্বলে যাচ্ছে। আল্লাহর কসম! এ মহৎ ব্যক্তি যদি আমাকে অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার জীবন বাজী রেখে খলীফাকে হত্যা করব… এ মহৎ, ব্যক্তিকে যেই চিনবে সেই তার ব্যাপারে একথা বলবে যা আমরা পরস্পরে আলোচনা করলাম।
খিজির বললেন, তুমি কে? চাল-চলনে, কথা-বার্তায় তো মনে হচ্ছে শামী। সে ব্যক্তি বলল, তুমি ঠিকই বলেছ ভাই, ঠিকই বলেছ, আমি শামী।
সে থলী হতে দু’টো স্বর্ণ মুদ্রা বের করে মুসার কোলের উপর ফেলে দিয়ে বলল, আমি অচিরেই তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব এবং সম্ভব কোন ভাল খবরই নিয়ে আসব।
সে চলে গেল।
***
খিজির মুসাকে বললেন, দেখলেন ইবনে নুসাইর? যে আপনাকে চিনে সেই আপনার মুক্তির জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত।
মুসা বললেন, কিন্তু আমি নিজের জীবনের জন্যে অন্য কারো জীবনকে বিপদের সম্মুখীন করতে চাইনা। আমি মুক্তি কামনা একমাত্র আল্লাহর কাছেই করি।
ইউসুফ বললেন, আপনার দু’লাখ জরিমানা আমরা ফিরে গিয়ে আদায় করে দেব। এখন তো আমরা কেবল রাস্তার খরচ নিয়ে এসেছি।…
খিজির বললেন, আমার গোত্রের লোকেরা আপনার জন্যে দান করে দেরহাম দিনারের স্তূপ বানিয়ে দেবে।
তারা দু’জন মুসার সামনে থেকে উঠার কোন চিন্তেই করছিলেন না। মুসার প্রতি তাদের এ পরিমাণ ভক্তি শ্রদ্ধা যে, তারা তাকে এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। মুসা তাদেরকে বললেন, তোমরা চলে যাও, আমি খলীফার বন্দি, সে আমাকে এখানে বসিয়ে আমার কথা ভুলে যায়নি। তার সৈন্য বাহিনীর মাধ্যমে আমার প্রতি লক্ষ্য রাখছে। সে জানে আমি যাদের আমীর ছিলাম তারা আমার মান মর্যাদার কথা ভুলে যায়নি, ফলে আমাকে এ লাঞ্ছনা-গুঞ্জনার মাঝে দেখে কেউ প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তা করতে পারে।
তারা দু’জন সেখান থেকে কেবলি উঠতে যাচ্ছিল এরি মাঝে হঠাৎ করে চারজন ব্যক্তি খোলা তলোয়ার হাতে তাদের দুজনের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের মাঝ থেকে একজন ইউসুফ-খিজিরকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাদের দু’জনকে খলীফা তলব করেছেন।
খলীফা আমাদেরকে কি উদ্দেশ্যে ডেকেছেন? ইউসুফ জিজ্ঞেস করলেন, সে ব্যক্তি বলল, এর জবাব কেবল খলীফা দিতে পারবেন, আমরা তো হুকুমের দাস, তোমরা তাড়াতাড়ি চল।
খিজির বললেন, “যদি আমরা না যাই?”
সে ব্যক্তি বলল, তাহলে তোমাদেরকে এখান থেকে টেনে-হেঁছড়ে নেয়া হবে এ ব্যাপারেও খলীফার নির্দেশ রয়েছে। তোমাদেরকে ঘোড়ার পিছে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তোমরা দ্রুত রওনা হও।
মুসা বললেন, বন্ধুরা আমার! তোমরা খলীফার হুকুম অমান্য করোনা, তাদের সাথে রওয়ানা হয়ে যাও, লাঞ্ছনার হাত থেকে বাঁচ, আল্লাহ তোমাদের হিফাজতকারী।
আগত চারজন দু’জন বর্বরকে নিয়ে চলে গেল। মুসা ইবনে নুসাইরের নয়ন যুগল অশ্রুতে ভরে উঠল।
***
হাজীদের তাবুর অদূরে আরেকটি তাবুর বসতি স্থাপিত হয়েছিল। এ তাবুগুলোর মাঝে একটা তাবু বেশ বড় ছিল। এটা নামে ছিল তাবু, মূলত: ছিল রঙিন ঝালর বিশিষ্ট শামিয়ানার সুসজ্জিত কামরা। তার মাঝে রেশমী পর্দা ঝুলছিল। একটা বড় পালং তার উপর রেশমের মশারী ঝুলান ছিল। নিচে অত্যন্ত দামী গালিচা বিছান। পালং এর অদূরেই সোফার মত একটা চেয়ার রাখা ছিল। চেয়ারের সামনে ছোট একটা খাটে মখমলের গিলাফে ঢাকা গদি বিছান। চেয়ারে উপবেসনকারী ঐ গতিদে পা রাখেন।