ইহুদীদের এক ধর্মগুরু বলল, রডারিকের ফৌজে শামিল হবার বিষয়টাই। কেবল নয় বরং তাকে কিভাবে ক্ষতি করা যায় সে ব্যাপারেও আমাদের চিন্তে-ভাবনা করতে হবে।
অন্য আরেকজন ধর্মগুরু বলল, আগে থেকেই ফৌজে কিছু ইহুদী শামিল রয়েছে, তাদেরকে কিভাবে বের করে আনা যায় সে ব্যাপারে ভাবার দরকার।
অন্য আরেকজন বলল, আমি অন্যদিক চিন্তে করছি। যারা ফৌজে রয়েছে তাদেরকে ফৌজে রেখে রডারিকের ফৌজের বিরুদ্ধে তাদেরকে লাগানো যেতে পারে।
একজন প্রশ্ন করল, তাদের বিরুদ্ধাচরণের কথা যদি কেউ জেনে যায়?
জবাবে অপর জন, কেউ জানতে পারবে না।
অন্যজন বলল, যদি এটা জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আমি এর চেয়ে আরো বড় ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে পারব।
সৃষ্টিগতভাবেই ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী। মাটির নিচ থেকে গোড়া কাটার ব্যাপারে তারা যেমন পারদর্শী অন্যকোন কওম এমনটি নয়। তাদের ধর্মগুরু এ ব্যাপারে ফায়সালা করল যে, প্রতিটি ইহুদীর ঘরে এ খবর পৌঁছে দিতে হবে যেন কেউ রডারিকের ফৌজে শামিল না হয়।
***
অর্ধবয়সী এক আওরত। নাম তার মেরীনা। যৌবন ডলে গিয়েছিল কিন্তু লম্বা দেহলতা ও ছন্দময়ী চেহারাতে প্রেমের আবেদন ও আকর্ষণ পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তার প্রতি যারা লক্ষ্য করত তাদেরকে তার যাদুময়ী আঁখি যুগল পাগল করে ফেলত। সে কোন সাধারণ ও মামুলী আওরত ছিল না। তাকে শাহী মহলের বেগমদের মাঝে গণ্য করা হত। সে রডারিকের রক্ষিতা ছিল এবং একমাত্র সেই কেবল যৌবন ঢলে যাবার পরও শাহী মহলে বহাল তবীয়তে বিদ্যমান ছিল। মহলের কোন রমণী ত্রিশ বছরে উপনীত হলেই তাকে গায়েব করে দেয়া হত বা ইনয়াম হিসেবে ফৌজের কোন আলা-অফিসারকে দিয়ে দেয়া হত।
মেরীনা ইহুদী ছিল। ইহুদীদের স্বভাব মুতাবেক সেও ষড়যন্ত্রকারীনি ছিল। একেতো সে ছিল রমণী দ্বিতীয়ত: ছিল অত্যন্ত সুন্দরী ও মায়াবী। অধিকন্তু চক্রান্তকারী সুচতুর ইহুদীর মেধা। এ সকল সিফত ও বৈশিষ্ট্য বলে সে মহলে বিশেষ স্থান দখল করেছিল। সেজে ছিল শাহী হেরেমের রাণী। তার কৃষ্ণকালো আঁখি যুগল ও বচন ভংগিতে ছিল যাদু পরশ ও সম্মোহনী প্রবল আকর্ষণ। যার হাত থেকে রডারিকও পারেনি বাঁচতে।
সে সময় স্পেনের রাজধানী টলেডোর শাহী মহল হতে এক দেড় মাইল দূরে সবুজ শ্যামলে ঘেরা একটা ঝিল ছিল, সে ঝিলের এক পাশে ছিল গাছ-পালা লতা গুল্মে ঢাকা একটা উঁচু টিলা। সে ঝিলের কাছে কোন পুরুষের যাবার অনুমতি ছিল না কারণ তা শাহী মহলের আওরতদের জন্যে খাছ করে দেয়া হয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলে সেথায় আওরতরা সন্তরন, নৃত্য, গান-বাজনা ও আমোদ-প্রমোদের জন্যে যেত।
বিকাল বেলা। সূর্য বিদায়ের জন্যে পশ্চিম দিগন্তে উঁকি-ঝুঁকি মারছে। ঝিল পাড়ে পঁচিশ-ত্রিশজন রমণী গল্প-গুজব, খেলা-ধুলা, হাসি-তামাশায় মেতেউঠেছে। তাদের মাঝে কিশোরী ও পূর্ণযৌবনা ললনারাও রয়েছে। প্রতিদিনই তারা এ ঝিল পাড়ে এ ধরনের কর্মে লিপ্ত হত। তাদেরকে নেগরানী করত মেরিনা। সে বিকেলেও মেরীনা তাদের নেগরানী করছিল।
ঝিল অদূরে গাছের আড়ালে ললনাদের অশ্ব গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল যার কোচওয়ান ছিল পুরুষ। কোচওয়ানদের একজন দেখতে পেল এক ব্যক্তি ঐ সীমানার ভিতরে এসে গেছে যার কাছে কাউকে আসার অনুমতি দেয়া হয় না। কোচওয়ানরা তাকে ফিরে যাবার জন্যে ইশারা করল কিন্তু সে তার প্রতি লক্ষ্য না করে সম্মুখে অগ্রসর হয়েই চলল, কোচওয়ানরা তাকে বাধা দেয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালে সে রাস্তা পরিবর্তন করে অগ্রসর হতে লাগল, তাকে বাধা দিতে দিতে সে ঝিল পাড়ে গিয়ে উপনীত হলো। কোচওয়ানরা তাকে পাকড়াও করল, সে কেবল চোখ দুটো খোলা রেখে মাথা ও মুখমণ্ডল পুরো চাদরে ঢেকে রেখেছিল। সে পা পর্যন্ত লম্বাচোগা পরিহিত ছিল। কোচওয়ানরা তাকে পাকড়াও করলে সে চিৎকার শুরু করল। ঝিল পাড়ে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত আওরতরা সে আওয়াজ শুনে মনে করল কোন জানোয়ারের আওয়াজ। তারা তার প্রতি তেমন লক্ষ্য করল না। কেবল মেরীনা তার প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করল কারণ ইতিপূর্বে কিছু মানুষের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। সে যেহেতু নেগরান ছিল তাই কাপড় পরিধান করে যেদিক থেকে আওয়াজ এসেছিল সেদিকে রওনা হল। মেরীনা সামনে অগ্রসর হয়ে দেখল, কোচওয়ানরা পাগলের ন্যায় এক ব্যক্তিকে ধরে টানা-হেঁছড়া করছে আর সে আশ্চর্যজনকভারে চিৎকার করছে। কেবল কোন পাগলের পক্ষেই সম্ভব ছিল সে নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করা। সে মেরীনাকে দেখেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, ঐ যে রানী এসে গেছে। এ কথা বলেই মেরীনার দিকে দৌড় দিল। কোচওয়ানরা তাকে ধরার চেষ্টা করল কিন্তু দ্রুত দৌড়াচ্ছিল তাই তারা ধরতে পারল না ফলে সে মেরীনার কাছে গিয়ে পৌঁছুল। মেরীনার পদতলে লুটিয়ে পড়ল। মেরীনা কিছুটা পিছে সরে গেল।
সে মাথা তুলে বলল, মেরীনা! আমি আওপাস, তোমার মিলনে এসেছি। কোচওয়ান এসে তাকে পাকড়াও করে নিয়ে যেতে চাইল।
মেরীনা : ছেড়ে দাও। বেচারা পাগল, কারো কোন ক্ষতি করবে না। তোমরা চলে যাও।
আওপাস দুঃখ ভরা স্বরে বলল,আমি পাগল নই মেরীন! পাগল নই! আমি ফরীয়াদি, আমি মাজলুম।
সে ডেজার ভাই আওপাস ছিল, যে ডেজার বিরুদ্ধে রডারিক বিদ্রোহ করিয়ে তাকে হত্যা করে নিজে শাহী মসনদ দখল করেছে। সে সময় আওপাসের বয়স ছিল সতের-আঠার বছর। আওপাস ছিল গোথা বংশীয়। ডেজা ছিল সর্বশেষ গোথা বাদশাহ্। মেরীনা এক ইহুদী ব্যবসায়ীর বেটী। ডেজার হুকুমতের সময় তার ওমর ছিল ষোল-সতের বছর। আওপাস মেরীনাকে প্রথম দেখাতে ভালবেসে ফেলেছিল কিন্তু মেরীনা তার সে ভালবাসাকে গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছি।