আমি পয়গাম লেখাচ্ছি আর যে দৃশ্য দেখছি সে দৃশ্য আমীরে মুহতারাম ও খলীফাতুল মুসলিমীনেরও প্রত্যক্ষ করার মত। দুশমনের লাশ এত বেশী যে শেষ হচ্ছে না। জংগী কয়েদীর দ্বারা লাশ সরাচ্ছি। যত গর্ত ছিল তাতে লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে, গত শেষ হয়ে গেছে কিন্তু লাশ শেষ হয়নি। বাকি শবদেহ সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ছয়শত অশ্ব হস্তগত হয়েছে। মৃত দুশমনের হাতিয়ারের স্তূপ জমেছে।
এখন অতিরিক্ত ফৌজের সাহায্য প্রয়োজন। খবর পেয়েছি, স্পেন ফৌজ অনেক বেশী এবং সম্মুখে কেল্লাবন্দি শহর। আমি অতিরিক্ত ফৌজের জন্যে ইন্তেজার করে সম্মুখে অগ্রসর হব। আমাদের কামিয়াবীর জন্যে দোয়া করবেন। আমরা যদি পরাজিত হই তাহলে আর ফিরে আসব না, কারণ ফিরে আসার কোন রাস্তাই নেই। আমরা যে চারটি জাহাজে এসেছিলাম তা অগ্নিসংযোগ করে ভস্মিভূত করা হয়েছে।”
মুসা ইবনে নুসাইর হর্ষফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন, সাবাশ! তোমাকে কোন শক্তি পরাজিত করতে পারবে না।
মুসা ইবনে নুসাইর তারেক ইবনে যিয়াদের বিজয় খবর ও তার জন্যে সাহায্যের আবেদন করে তখনই খলীফা ওয়ালীদ ইবনে মালেকের নামে একটা পয়গাম লিখিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
***
পামপিলুনাতে রডারিক হুকুম জারি করলেন, এখান থেকে টলেডো পর্যন্ত যেন এ ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয় যে, স্পেনে বহিরাগত কওম অনুপ্রবেশ করেছে যারা এত শক্তিশালী ও রক্তপিপাসু যে, তাদের চেয়ে দ্বিগুণ ফৌজকে তারা খতম করে দিয়েছে। রডারিক তার ফরমানে একথাও বলে ছিল যে আক্রমণকারীদের ব্যাপারে যেন মানুষকে ভয় দেখান হয় এবং বলা হয়, তারা দস্যুদল, তারা-তোমাদের ধন সম্পদ ও আওরতদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে আর তোমাদের মুলকে লাগাবে আগুন, তোমাদেরকে করবে হত্যা।
সরকারী কর্মচারীরা তাৎক্ষণিক ঘোড়া ছুটিয়ে চলল। তারা প্রত্যেক গ্রাম মহল্লার কর্মচারীর কাছে এ পয়গাম পৌঁছিয়ে টলেডোতে গিয়ে পৌঁছল তারপর প্রত্যেক বস্তি ও গির্জাতে এলান হতে লাগল,
“সমুদ্রের দিক থেকে এক অজ্ঞাত মুলকের এক বড় দস্যুদল ও লুটেরা আমাদের মুলকে প্রবেশ করেছে। তারা আমাদের অনেক বড় ফৌজী দলকে হালাক করে দিয়ে তুফানের মত সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। তারা বাড়ীতে হানা দিয়ে নগদ টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ কবজা করছে আর জওয়ান আওরতদেরকে নিজেদের সাথে নিয়ে যাচ্ছে তারপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঘরে অগ্নি সংযোগ করছে। তাদের এ ধ্বংসলীলা হতে ইবাদতগাহও রক্ষা পাচ্ছে না। নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চাদেরকে বর্শার আঘাতে হত্যা করছে আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।
শাহান শাহেউন্দুলুস, তার ফৌজ নিয়ে ঐ ভয়ানক লস্করের মুকাবালায় বেরুচ্ছেন, বাদশাহ্ রডারিক নির্দেশ দিয়েছেন, যে সকল লোক তীর আন্দাজী, তলোয়ার পরিচালনা করতে পারে তারা যেন ফৌজে শামিল হয়। যারা ফৌজে শামিল হবে তারা ভাতা পাবে অধিকন্তু দস্যু দল থেকে যা করতলগত হবে তারও একটা অংশ থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় ফায়দা হবে তোমাদের জান-মাল, তোমাদের ঘর-বাড়ীও লাড়কীরা নিরাপত্তা পাবে…..।
লোক সকল প্রস্তুত হয়ে যাও। হাতিয়ার ও ঘোড়ায় মোয়র হয়ে নিজের ইজ্জত ও ধন-সম্পদ লুট থেকে বাঁচাও আর তা যদি না কর তাহলে আজই বাল-বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলে চলে যাও এবং কমজোর বুজদিল হয়ে জানোয়ারের মত দিন গুজরান কর। তারপর যখন ফিরে আসবে তখন নিজেদের ঘর-বাড়ীর আর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না।
জওয়ান ও অর্ধ বয়সী লোকেরা অত্যন্ত স্পৃহা ও উদ্দীপনার সাথে গায়ের মুলকী লঙ্করকের মুকাবালার জন্যে তৈরী হতে লাগল। তাদেরকে বলা হলো বাদশাহ্ রডারিক অমুক রাস্তা দিয়ে টলেডো যাবেন; ফৌজে শামিল হতে ইচ্ছুক সে যেন রাস্তায় অপেক্ষমান থাকে।
***
কিছু ইবাদত খানায় এ এলান হচ্ছিল না, সেগুলো ছিল ইহুদীদের ইবাদত খানা। তাদের সংখ্যা বেশী ছিল না। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে স্পেনে ইহুদীরা ছিল অত্যন্ত মাজলুম। কারীগরি, প্রকৌশলী, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ইহুদীদের হাতে কিন্তু তাদের পয়সা ছিল না। তাদের থেকে এত পরিমাণ কর আদায় করা হত যার ফলে তাদের কাছে দু’মুটো খাবারের পয়সা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না। তাদের নিম্ন শ্রেণীকে অস্পর্শ মনে করা হত।
স্পেনের শাহী মসনদ যখন ডেজার হাতে আসল তখন সে খ্রীষ্টানদের মত ইহুদীদেরকে পদ মর্যাদা দিয়ে টেক্স কমিয়ে দিল। ইহুদীদের খুব সুরত লাড়কীদেরকে জোরপূর্বক গির্জার অধীনে অর্পন করা হত, ডেজা এ নিপীড়নের পথও বন্ধ করে দিল। কেবল ইহুদীদেরই নয় বরং সর্বসাধারণের জীবন মানও সে উন্নত করল আর এটাই তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। রডারিক তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়ে নিজে শাহী মসনদে বসল। স্পেনের শাহী মুকুট নিজের মাথায় পরেই সে ডেজাকে হত্যা করল।
বহিরাগত শত্রুর মুকাবালায় লোক ফৌজে শামিল হবার ব্যাপারে যখন গির্জায়, শহরের চৌকিতে, গ্রামে-গ্রামে, পল্লীতে পল্লীতে এলান হচ্ছিল তখন ইহুদীদের ইবাদত খানায় অন্যদিক নিয়ে গোপন আলোচনা চলছিল।
ইহুদীদেরকে ফৌজে শামিল হওয়া থেকে কিভাবে বাধা দেয়া যায় এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যে একদিন পাঁচ-ছয়জন ইহুদী সর্দার এক ইবাদত খানাতে একত্রিত হলো। তারা কোন অবস্থাতেই রডারিককে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিল না।