এই বিশেষ হিদায়েতই স্পেন ফৌজ আসার পূর্বে তারেক ইবনে যিয়াদ তীর আন্দাজ কমান্ডারদেরকে দিয়েছিলেন। দুশমন আসার পূর্বেই তীর আন্দাজদেরকে বৃক্ষে এবং টিলার ওপর প্রস্তুত রাখা হয়েছিল আর তারেক ইবনে যিয়াদের পিছু হটার মাকছাদ এটাই ছিল যে যাতে দুশমনকে তীর আন্দাজদের জালে ফেলা যায়। তার এ কৌশল সফল হয়েছিল।
তারেক ইবনে যিয়াদ নির্দেশ দিলেন, “এলান করে দাও দুশমনের ঘোড়া যেন জখম না হয়, আমাদের ঘোড়ার প্রয়োজন রয়েছে, তবে দুশমনের কোন সোয়ার যেন জিন্দা যেতে না পারে।
তার এ নির্দেশ সমস্বরে এলান হতে লাগল।
তিতুমীর তার ফৌজের অবস্থা লক্ষ্য করছিল। তার কাছে তখনও অনেক ফৌজ মওজুদ ছিল। অপর দিকে মুসলমানদের ফৌজ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একদল ডানে অপর দল বামে অবস্থান করছিল। তিতুমীর একই সাথে দু’দলের ওপর হামলা চালাবার হুকুম দিল। তারেকের দেয়া হিদায়াত মুতাবেক উভয় দল আরো বেশী ডানে-বামে সরে গেল যাতে দুশমনের ফৌজ আরো বেশী বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
বর্বর মুসলমানরা খুবই খুন পিয়াসু যুদ্ধবাজ ছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটতরাজ হত্যাযজ্ঞ করাই ছিল তাদের পেশা। ইসলাম তাদেরকে যুদ্ধের নব উদ্দীপনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়েছিল। ফলে তাদের যুদ্ধের ধরণ পালটিয়ে গিয়ে ছিল। তারা প্রথমে নিজেরা পরস্পরে লড়াই করত। স্বয়ং ঈসায়ী ঐতিহাসিকরা লেখেছেন, মুসলমানদের মাঝে যুদ্ধের যে স্পৃহা ছিল স্পেন ফৌজের মাঝে তা ছিল না। স্পেন ফৌজ নিজেদেরকে বাদশাহর নওকর মনে করতো আর তারা বেতন-ভাতার জন্যে লড়াই করতো এবং তার জন্যেই জীবিত থাকতে চায়তো। পাদ্রীরাও শাহী খান্দান ও আমীর উজীরদের মত বিলাসী জীবন যাপন করত। স্পেনে বেশ অনেক সংখ্যক ইহুদী বাসিন্দা ছিল কিন্তু খৃস্টানরা তাদেরকে নিজেদের দাস বানিয়ে রেখেছিল। ইহুদী ললনাদের আরও হেফাজত ছিল না। কোন সুন্দরী-মায়াবী, যুবতী ইহুদী লাড়কী দেখলেই পাদ্রীর হুকুমে তাকে গির্জার সম্পদে পরিণত করা হত। পাদ্রীরা বলত তাকে গির্জা বাসিনী বানান হবে কিন্তু পাদ্রীরা তাদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করত। শাহী খান্দান ও ধর্মগুরুরা তাদেরকে নিজের দাসীতে পরিণত করত। শাহী খান্দান ও ধর্মগুরুদের এ কীর্তি ফৌজদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। তাই মাল্লা ও জেলেরা মুগীছে রূমীকে বলেছিল সৈন্যরা কোন নজওয়ান খুব সুরত লাড়কী দেখলে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়।
মুসলমানরা স্পেন লস্করের হামলা, অত্যন্ত দৃঢ়তা, সাহষীকতার সাথে প্রতিহত করল। তারা সংখ্যায় কমছিল কিন্তু যুদ্ধ স্পৃহায় ছিল পাগল পারা। তিতুমীরের ধারণা ছিল তার এত বড় বিশাল বাহিনী ক্ষণিকের মাঝে মুসলমানদের এ স্বল্প সৈন্যকে পরাস্ত করে হত্যা করবে। তারেকের দক্ষতা ও বিচক্ষণতায় তার আশার গুড়ে বালি পড়ল।
তারেক ইবনে যিয়াদ দুশমনের পাশে যে টিলা ছিল তার মাঝে পূর্বেই ঘোড় সোয়ারদেরকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি যে দল নিয়ে হামলা করে পিছু হটে আসলেন সে দলকে কৌশলে ঘোড় সোয়ারদের কাছে নিয়ে গেলেন, তারপর তিনি পায়দল ও ঘোড় সোয়ারদের নির্দেশ দিলেন তারা টিলার আড়াল দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে যেন স্পেন ফৌজের পশ্চাদ হতে আক্রমণ করে বসে।
তারেকের এ কৌশল তিতুমীরের জন্যে অপ্রত্যাশিত ছিল। তার ধারণা ছিল তাদের পশ্চাদ দিক নিরাপদ রয়েছে। পশ্চাদে হামলার নেতৃত্বে তারেক স্বয়ং ছিলেন, আর তার দুই সেনাপতি মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ সম্মুখ হতে অবিরাম গতিতে তীর-বর্শার আক্রমণ করছিলেন।
তারেক তিনশত ঘোড় সোয়ার ও দু’হাজার শার্দুল পায়দল নিয়ে পশ্চাদ দিক থেকে স্পেন ফৌজের ওপর বীরবিক্রমে হামলা করার পর তিতুমীর বুঝতে পারল পিছন দিক হতে তাদের ওপর বিপদ ধেয়ে আসছে। মুহূর্তের মাঝে তার দুহাজার ফৌজ খতম হয়ে গেল আর যারা জীবিত ছিল তারা ভয়াবহ আত্মচিৎকারে নিজেদের অন্যান্য ফৌজের মাঝে গ্রাস সৃষ্টি করছিল। স্পেন ফৌজের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ল। তারেকের পূর্ব পরিকল্পনা, মুতাবেক মুগীছে রূমী ও আবু জুরয়া তুরাইফ তাদের ফৌজ নিয়ে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী স্পৃহা ও বীরত্বে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্পেন সোয়ারীদের ঘোড়া তাদের ফৌজের জন্যে চরম বিপদ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারেক নির্দেশ দিয়েছিলেন দুশমনের ঘোড়া জখম না করে সহীহ সালামতে ধরার জন্যে। ঘোড় সোয়ারী জখম হয়ে হয়ে নিচে পড়ছিল আর ঘোড়া লাগামহীন হয়ে দিগবিদিক উম্মাদের ন্যায় ছুটছিল এবং ফৌজকে পায়ের তলে পৃষ্ঠ করছিল। তারেকের তীর আন্দাজরা স্পেন ফৌজের জন্যে আরো বড় মসীবত ডেকে আনছিল। তারা গাছের ওপর হতে অবিরাম তীর নিক্ষেপ করে দুশমনের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করছিল।
তিতুমীর তার সারিবদ্ধ ফৌজের মধ্যখানে ছিল। সৈন্য পূর্ণ বিশৃংখল হয়ে গিয়ে ছিল। তার হুকুম কেউ শুনছিল না। তার ফৌজের প্রতিটি সদস্য যার যার মত একাকী পলায়ন করছিল। অর্ধেক সৈন্য খতম হয়ে গিয়েছিল। কোন জখমী সৈন্য পড়লে পায়দল ও ঘোড়ার পদতলে সেও পৃষ্ঠ হয়ে খতম হচ্ছিল।
জুলিয়ন মুগীছে রূমীকে লক্ষ্য করে বললেন, মুগীছ! কয়েকজন জানবাজ ফৌজ পাঠাও, তারা তিতুমীরকে গ্রেফতার করে আনবে।
মুগীছ : যুদ্ধের যে অবস্থা এ পরিস্থিতিতে তার কাছে পৌঁছা যাবে না।