একদিন দক্ষিণ আফ্রিকার দু’জন হাজী চলতে চলতে ভিখারীর কাছে আসলে ভিখারী তার নির্ধারিত শব্দে আওয়াজ করলে এক আফ্রিকী বলল, এ কোন জ্ঞানী ভিখারী বলে মনে হচ্ছে। অন্য জন বলল,
“হ্যাঁ, তাইতো মনে হচ্ছে, অন্য ভিখারীদের মত সে নিজের অভাবের কথা কেঁদে কেটে প্রকাশ করছে না।”
দু’জন আফ্রিকী থলী হতে পয়সা বের করছিল। ভিখারী মাটিতে বসে উপরের দিকে চেয়ে তাদেরকে দেখছিল। এক আফ্রিকী তাকে পয়সা দিতে গিয়ে থমকে গেল, সে ভিখারীর সামনে বসে চিবুকের নিচে হাত দিয়ে চেহারা দেখে, ভিখারীকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কি?” ভিখারী বলল, “আমার কোন নাম নেই।” আল্লাহ তায়ালার এ ফরমান “তিনি যাকে ইচ্ছে সম্মান দান করেন আৰু যাকে ইচ্ছে লাঞ্ছিত করেন, এর বাস্তম নমুনা আমি।”
আফ্রিকী বলল, “খোদার কসম! তুমি মূসা… মূসা ইবনে নুসাইর!”
আমীরে আফ্রিকা স্পেন বিজেতা? অপর আফ্রিকী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।
বুড়ো ভিখারীর চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
এক আফ্রিকী জিজ্ঞেস করল, “কোন্ অপরাধের শাস্তি তুমি ভোগ করছ?”
বৃদ্ধ ভিখারী আকাশের দিকে ইশারা করে বলল, কোন অপরাধেরই নয়।
অন্য আফ্রিকী বলল, “আমরা শুনেছি তুমি খলীফার রোষানলে পড়েছ, কিন্তু আমরা এটা তো কখনো কল্পনাও করিনি যে তুমি ভিক্ষুক হয়েছ।”
“ভিক্ষুক বানানো হয়েছে, মুসা ইবনে নুসাইর বললেন, পায়ের ওপর হতে। কাপড় সরিয়ে আরো বললেন, আমি বাদশাহর কয়েদী, দামেস্কের ঐ কয়েদ খানায় বন্দি হয়েছি যেখানে এ বাদশাহ্ সিন্ধু বিজেতা মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দুশমনদের হাতে নানা ধরনের শাস্তি দিয়ে হত্যা করেছে। বাদশাহ হজ্জ্ব করতে এসেছে আর আমার প্রতি এ হুকুম জারি করে এখানে এনেছে যে, আমি ভিক্ষা করে দু’লাখ দেরহাম তাকে পরিশোধ করব তানাহলে এভাবে পায়ে শিকল পরিহিত অবস্থায় সারা জীবন ভিক্ষা করব। এক আফ্রিকী আশ্চর্য হয়ে বলল, “দু’লাখ দেরহাম। এটা কি স্পেন বিজয়ের জরিমানা?”
এ প্রশ্নের জবাব বেশ কিছুটা লম্বা ছিল। এত বেশী কথা বলার শক্তি হয়তো মুসার ছিল না বা তিনি জবাব দিতে চাচ্ছিলেন না। তাই তিনি প্রশ্নের জবাবে প্রশ্নকারীর দিকে একবার মাথা উঁচু করে তাকালেন তারপর মাথা এমনভাবে নিচু করে ফেললেন যেন তন্দ্রা এসেছে। তার বয়স আশির দোর গোড়ে পৌঁছেছিল। জীবনের কম-বেশী ষাট বছর তিনি যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করে, সফর করে ও তাবুতে অতিবাহিত করেছেন। তিনি কয়েকটা যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার শরীরে এমন কোন অংশ ছিল না যেখানে ক্ষত চিহ্ন ছিল না।
তার ক্ষত-বিক্ষত অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্ব এক জীবন্ত উজ্জ্বল ইতিহাস, ইসলামী মুজাহিদ বাহিনীর ইতিবৃত্ত। তিনি একজন বিজ্ঞ আলেম ও পণ্ডিত ছিলেন। বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তার অসাধারণ খ্যাতি ছিল।
যে দুজন আফ্রিকী তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা দু’জনই দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসী বর্বর ছিল এবং দুজনই ছিল নিজ নিজ গোত্রের সর্দার। বর্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় দাঙ্গাবাজ ও হিংস্র একটা জাতি ছিল। বর্তমানে জুলুম ও নির্যাতনের ব্যাপকতা ও কঠোরতা বুঝানোর জন্যে যে বর্বরতা শব্দব্যবহার করা হয় তা ঐ বর্বর জাতির থেকেই উদ্ভূত ও প্রচলিত।
বর্বররা মারামারি, হানাহানি, রাহাজানী, হত্যা, লুণ্ঠনের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু যুদ্ধ বিদ্যায় তারা পুরোপুরি পারদর্শী ছিল না। তাদের বীরত্ব, হত্যাযজ্ঞের দরুন তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষও ভীতু হয়ে পড়ত। তারা বেশ কয়েকবার পরাজিত হয়েছে কিন্তু কোন বিজেতাই তাদের ওপর বেশি দিন প্রভাব খাটাতে পারেনি। পরিশেষে আররের মুসলমানরা তাদের প্রতি মনোনিবেশ করে। মুজাহিদ বাহিনীর সিপাহ্ সালার উকবা ইবনে নাফে ফাহুরী গুরুতর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে বর্বরদের উপর বিজয় অর্জন করেন।
বর্বররা বেশ কিছু কাল বিদ্রোহ করেছিল, কিন্তু আরবের সিপাহসালাররা রন শক্তিতে সে বিদ্রোহের আগুন না নিভিয়ে বরং ইসলামী নিয়ম-কানুন ও নীতির ভিত্তিতে চিরতরে খুতুম করেন। বর্বরদের একটা ধর্ম ছিল কিন্তু তাদের কৃষ্টি কালচারের কোন ভিত্তি ছিল না। বিজয়ী মুসলমানরা যখন তাদের সম্মুখে ইসলামের মর্মবাণী তুলে ধরেন তখন তারা অতিদ্রুত ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মুসলমানরা তাদেরকে সৈন্যবাহিনী ও ব্যবস্থাপনার বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। তাদের দ্বারা পুরোপুরি যুদ্ধ করান হয়েছিল। এভাবে তাদের মাঝে শৃংখলা ফিরে আসে আর বর্বররা ইসলামের এক বড় যুদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়।
***
তখন মুসা ইবনে নুসাইর আফ্রিকার আমীর ছিলেন। তিনি তার দূরদর্শিতা বলে বর্বরদের বিদ্রোহের সর্বশেষ আগুনকেও নিভিয়ে দিয়ে ছিলেন। যে মুসা যুদ্ধের ময়দানে চরম কঠোর ও গোস্বায় অগ্নিশর্মা হয়ে পড়তেন তিনি বিদ্রোহী বর্বরদের জন্যে রেশমের চেয়েও বেশী নরম আর মধুর চেয়ে বেশী মিষ্টি হয়ে ছিলেন। তার এ সুন্দর কর্ম পন্থা বর্বরদেরকে বিশেষ করে তাদের সর্দারদেরকে ইসলামের পাগল ও মন জয়ী মুজাহিদ বানিয়ে দিয়েছিল।
***
যে দু’জন বর্বর সর্দার মক্কাতে মুসা ইবনে নুসাইয়ের সামনে বসেছিল তারা উভয়ই তার হাতে গড়া এবং তার থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাদের একজন ছিলেন ইউসুফ ইবনে হারেছ অপর জন ছিলেন খিজির ইবনে গিয়াস। ইসলাম গ্রহণ করার পর আরবরা তাদের এ নাম রেখেছিল। মুসা আফ্রিকার আমীর থাকা অবস্থায় তার প্রতি তাদের যে সম্মান ছিল তাকে ভিখারী অবস্থায় দেখেও তারা সে সম্মান প্রদর্শন করছিলেন।