স্পেন অভিযান পরিচালনার বিষয় সম্মুখে উপস্থিত হওয়াতে মুসা ইবনে নুসাইরের দৃষ্টি বার বার তারেকের প্রতি যাচ্ছিল। মুসার দৃষ্টিতে তারেকের মাঝে সবচেয়ে বড় গুণ হলো সে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পাগলপারা, সে চায় সম্মুখে অগ্রসর হতে, পিছু হটতে যেন সে জানেই না।
মুসা তাকে ডেকে বললেন, স্পেন অভিযানে তাকে সিপাহ্ সালার নির্বাচন করা হয়েছে এই হলো স্পেনের নকশা। তার পরীক্ষা নেয়ার জন্যে মুসা সম্মুখে নকশা রেখে দিলেন। কিভাবে তুমি স্পেন মুলুকে হামলা করবে? ধরে রাখ তোমার লস্কর সংখ্যা বেশী হলে উধ্বে সাত হাজার হতে পারে তবে এর কমও হতে পারে কিন্তু বেশী হবে না। তারেক ইবনে যিয়াদ নকশা ভাঁজ করে রেখে দিলেন।
তারেক; আমীরে মুহতারাম! আমিএমন উসূল ও নিয়মে স্পেন উপকূলে সৈন্য অবতরণ করব যে লস্কর সম্মুখ পানেই কেবল অগ্রসর হবে পিছু ফিরার কেউ চিন্তেই করবে না…..। হয়তো বিজয় নয়তো মৃত্যু!
মুসার চেহারায় মৃদ হাসির রেখা ফুটে উঠল।
কায়রো ছিল মিশর ও আফ্রিকার দারুল হুকুমত। সিপাহ্ সালার মুন্তাখাব হবার। সাথে সাথে কায়রো শহরে তীর-বর্শা ও অন্যান্য হাতিয়ার তৈরী হতে লাগল। তীরও নিক্ষেপের জন্যে বর্শা অধিক হারে তৈরি হচ্ছিল। মুসা ইবনে নুসাইর তীর ও বর্শা বানানোর ব্যাপারে বলেছিলেন এত পরিমাণ বানাবে যাতে স্পেন থেকে খবর না আসে যে তা খতম হয়ে গেছে। মাঝখানে সাগর ছিল প্রতিবন্ধক। দুশমন কর্তৃক। রসদের রাস্তা অবরুদ্ধ হবার আশংকা ছিল।
যে সকল ফৌজ স্পেন রওনা হবে, তারেক ইবনে যিয়াদ তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। স্পেনের যে এলাকায় লড়াই হবে সে এলাকা সম্পর্কে তিনি জুলিয়নকে জিজ্ঞেস করে ছিলেন। জুলিয়ন তাকে বিস্তারিত বাতিয়ে দিয়ে ছিলেন। স্পেন প্রাকৃতিক দিক থেকে উত্তর আফ্রিকার চেয়ে ভিন্ন। সবুজ-শ্যামলে ঘেরা, পাহাড় পর্বত, নদী-নালা ইত্যাকার দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশ। তারেক ইবনে যিয়াদ। সেখানের সর্বোপরি বিষয় সামনে রেখে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
অবশেষে রওনার দিন এসে হাজির হলো। তারেককে যে ফৌজ দেয়া হয়েছিল তার সংখ্যা ছিল সাত হাজার। এর মাঝে কয়েকশ সোয়ারীও ছিল।. তাবৎ ফৌজ ছিল বর্বর। জুলিয়ন তাদেরকে চারটি যুদ্ধ জাহাজ, নিজের মাঝি-মাল্লা ও নাবিক দিয়েছিলেন। জাহাজগুলো এত বড়ছিল যে তাতে সাত হাজার ফৌজ, অশ্ব ও অন্যান্য আসবাবপত্র খুব সুন্দরভাবে সংকুলান হয়েছিল।
বিদায়ের প্রাক্কালে তারেক ইবনে যিয়াদ মুসার সাথে করমর্দন করে বলেছিলেন, আমীরে মুহতারাম! এখন থেকে কেবল বিজয় সংবাদ শুনতে পাবেন।
মুসা : একথা ভুলে যেওনা ইবনে যিয়াদ! দুশমন সংখ্যা এক লাখের বেশী হতে পারে।
তারেক ইবনে যিয়াদ : প্রতিটি লড়াইতেই দুশমন সংখ্যা আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী থাকে। আমি আপনাকে একটা বাশারত শুনাতে চাচ্ছি। গতরাতে আমি রাসূল (স)-কে খাবাবে দেখলাম, তিনি আমাকে বাশারত দিলেন, হিম্মত ও সবরের আঁচল মজবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, বিজয় তোমাদেরই হবে।
তারেকের এ খাব ঈসায়ী ঐতিহাসিকরাও তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন, এ দ্বারা বুঝা যায় এ খাব কোন মুসলমান ঐতিহাসিকের মস্তিষ্ক প্রসূত নয়।
যখন জাহাজ নঙ্গোর তুলে নিল তখন তীরে সমবেত হাজার হাজার নর-নারী ও শিশু-কিশোর দু’হাত ওপরে তুলে তাদের জন্যে প্রাণ খুলে দোয়া করছিল, তারপর তাদের সে হাত বিদায় সম্ভাষণের জন্যে আরো উপরে উঠেছিল। জাহাজের পালে হাওয়া লাগার পর ক্রমে তা দূরে চলে যেতে লাগল। রমণীদের নয়নযুগলে আঁসুর বান বয়ে গেল। এ সাত হাজার ফৌজের অধিকাংশের ভাগ্যেই ছিল স্পেনে দাফন। তারা আল্লাহর পয়গাম সমুদ্রের অপর পারে পৌঁছানোর জন্যে চিরতরে বিদায় হয়ে যাচ্ছিল। সে ঐতিহাসিক তারিখটি ছিল, ৭১১ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই।
উপকূলে যেখানে জাহাজ ভিড়েছিল তার নাম ছিল কিলপী, পরবর্তিতে জাবালুত তারেক নামে অভিহিত হয়। এনামই এ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।
তামাম লস্কর জাহাজ থেকে নামার পর তারেক ইবনে যিয়াদ তার ফৌজ দাঁড় করিয়ে দিলেন, মাঝি-মাল্লাদেরকে দাঁড় করালেন পৃথকভাবে। তারেক নিজে ঘোড়ায় চড়ে কিছুটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তারেক মাল্লাদেরকে নির্দেশ দিলেন, “চারটি জাহাজেই আগুন লাগিয়ে দাও।”
মাল্লারা পেরেশান ও হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল।
তারেক : জাহাজ থেকে তাবৎ সৈন্য নেমে গেছে মাল-সামান নামিয়ে নেয়া হয়েছে, জাহাজে আগুন লাগিয়ে দাও।
এ নির্দেশ তো কেবল সে সিপাহ্ সালার করতে পারে যার মেধা-বুদ্ধি বিকৃতি ঘটেছে।
তারেক বর্বর ফৌজদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, বর্বর ভাইরা! জাহাজে অগ্নি সংযোজন কর, আমরা জীবিত ফিরে যাবার জন্যে আসিনি।
বর্বররা সব গুলো জাহাজে আগুন লাগিয়ে ছিল।….
আগুন জাহাজের বাদাম, মাস্তুল, পাঠাতন সর্ব কিছু পুড়িয়ে ভস্ম করে দিচ্ছিল। দাউ দাউ করে জ্বলছিল। ধুম্রজালে স্পেনের গগন ছেয়ে যাচ্ছিল।
তারেকের গর্জন শুনাগেল। তাবৎ ফৌজ তার দিকে মনোনিবেশ করল, তার আওয়াজ ছিল দৃঢ় ও তেজস্বী। তিনি বর্বর ছিলেন তামাম লসকরও ছিল বর্বর কিন্তু তারেক ইবনে যিয়াদ লসকরকে লক্ষ্য করে বর্বর জবানের পরিবর্তে আরবি জবানে ভাষণ দিলেন। তার সে ভাষণ আজ পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং কিয়ামত তক থাকবে,