জুলিয়ন ফ্লোরিড়াকে সিওয়াস্তাতে নিয়ে এলো এবং পরের দিনই মুসা ইবনে নুসাইরের সাথে সাক্ষাতের জন্যে বেরিয়ে পড়ল।
***
মুসা ইবনে নুসাইর সতর্কতা অবলম্বনকে খুব জরুরী মনে করতেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, এক খ্রীষ্টান বাদশাহ্ অপর খ্রীষ্টান বাদশাহর ওপর মুসলমান দ্বারা আক্রমণ করাবে। তিনি ভাবছিলেন, এটা কোন ফন্দি হতে পারে। এ কারণে তিনি জুলিয়নকে কোন শান্তনা দায়ক জওয়াব দিচ্ছিলেন না।
জুলিয়ন : আপনি বিশ্বাস না করেন তাহলে আমার বেটী ফ্লোরিডাকে উপস্থিত করব, আপনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন।
মুসা : আমি হিজি নামের ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলতে চাই, তাকে আমার কাসেদ নিয়ে আসবে। আসার আগ পর্যন্ত তুমি তোমার সাথে আগত অফিসারসহ আমার মেহমান হিসেবে থাকবে।
সে মুহূর্তেই একজন কাসেদ হিজিকে আনার জন্যে সিওয়াস্তা পাঠিয়ে দেয়া হলো। সে সময় জুলিয়ন মুসা ইবনে নুসাইরকে স্পেন ও রডারিক সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিল, যা আজও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
জুলিয়ন : মুসা! রডারিকের ব্যাপারে দুশমনি আমার অন্তরে আজ নতুন সৃষ্টি হয়নি। এ দুশমনি অনেক পুরাতন। তুমি হয়তো জান স্পেনে গোথাদের রাজত্ব ছিল। রডারিক ছিল স্পেন ফৌজের সিপাহসালার। ডেজা নামের এক গোথা ছিল স্পেনের বাদশাহ্। সে সৃষ্টিগতভাবে নেক ইনসান ছিল। পাদ্রীরা ধর্মের আড়ালে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ জমা করে বিলাস বহুল জীবন যাপন করছিল। গীর্জা পরিণত হয়েছিল পাপের আড্ডা খানায়…
আর মূসা! পোপদের নির্দেশে সবকিছু হতো। পাদ্রীরা নিজ ইচ্ছেমত চলা ফেরা করত। যেহেতু তারা ধর্মগুরু ছিল এ কারণে সাধারণ ফৌজ ও জনগণ তাদেরকে সম্মান করত। বাদশাহও তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পেতেন। জীবন ব্যবস্থা এমন ছিল যে ধনী দিন বদিন ধনের পাহাড় গড়ে তুলছিল আর দরিদ্র ক্রমে হচ্ছিল নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর। প্রজারা মূলতঃ ছিল শাহী খান্দানের গোলাম। শ্রমিকদেরকে বেগার খাটান হতো বা একেবারে যৎসামান্য পারিশ্রমিক দেয়া হতো। জনসাধারণের জন্যে কঠিন শাস্তি নির্ধারিত ছিল যা সামান্যতম অপরাধেই প্রয়োগ করা হতো। জনগণের ওপর এত পরিমাণ কর আরোপ করা হয়েছিল যুদ্বরুণ তারা ক্ষুধার্ত দিন গুজরাত, অপর দিকে জনতার পয়সায় শাহী খাজানা ভরে উঠত। সে সম্পদ শাহী খান্দানের বিলাসীতা ও আরাম-আয়েশের পিছনে হতো ব্যয়।
ডেজা তখত নাসীন হলেন, আমার বিবি তারই বেটী। ডেজার অন্তরে ধর্মের ইহতেরাম ও আওয়ামের মহব্বত ছিল। তিনি তখত নাসীন হয়েই গীর্জা ও পাদ্রীদের প্রতি দৃষ্টি দিলেন। গীর্জাকে পাপের আড্ডা থেকে মুক্ত করলেন। তারপর তিনি নজর দিলেন ঐ সকল রাঘব বোয়ালদের দিকে যারা আওয়ামকে ভুখা-নাংগা রেখে তাবৎ সম্পদ জমা করত নিজ উদরে। তিনি সাধারণ জনতার ওপর থেকে কর উঠিয়ে তা আরোপ করলেন ধনীদের ওপর। তিনি সম্পদশালীদের সম্পদের পুংখানুপুংখ হিসেব-নিকেস করে নতুনভাবে তার উপর ট্যাক্স আরোপ করে তা আদায়ে বাধ্য করে ছিলেন। এভাবে ক্রমে সাধারণ জনগণের মাঝে শান্তি ফিরে আসছিল।…..
ধর্মগুরু, আমীর ওমারা, জায়গীরদার যে সম্পদ আম জনতাকে শোষণ করে জমা করেছে তা আবার তাদের হাতে ফিরে যাবে এটা মেনে নেয়া তাদের জন্যে খুবই কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল, তাই পাদ্রীরা এক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করে ফৌজের মাঝে এ প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলল যে বাদশাহ্ ডেজা ধর্মের ব্যাপারে নাক গলিয়ে ধর্মগুরুদেরকে স্বীয় গোলাম বানানোর চেষ্টা করছে। ফৌজ বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল, আর সে বিদ্রোহীদের নেতা ছিল রডারিক। ডেজার ওফাদার ফৌজ খুব স্বল্পই রইল, যারা রইল তারা বিদ্রোহীদের সাথে বেশীক্ষণ যুদ্ধ করতে পারল না। বিদ্রোহীরা বিজয়ার্জন করল। পাদ্রীরা রডারিককে শাহী মসনদে সমাসীন করল। সে মসনদে বসেই ডেজাকে কতল করার নির্দেশ দিল। সুতরাং তাকে কতল করা হল। তারপর আমীর ওমারা, শাহী খান্দান ও জায়গীরদার আবার বিলাসীতায় ডুবে গেল……
মুসা! আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি তুমি যদি স্পেন আক্রমণ কর তাহলে সেখানে সাধারণ জনগণ তাদের বিলাসী ও জালেম বাদশাহ্ এবং জেনারেলদেরকে ত্যাগ করবে। হতে পারে ফৌজও হয়তো রডারিকের ডাকে সাড়া দিবে না। তোমার ফৌজ যদি স্পৃহা-উদ্দীপনা নিয়ে লড়াই করে তাহলে স্পেন সৈন্য অতিদ্রুত ময়দান হতে পলায়নপদ হবে।
এ নাগাদ মুসা ইবনে নুসাইর তাকে কোন ফায়সালা শুনাননি।
***
চার-পাঁচদিন পর হিজি মুসার কাসেদের সাথে এসে পৌঁছল। সম্মানিত মেহমানের ন্যায় তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাকে মুসার কাছে পৌঁছে দেয়া হল। ফ্লোরিডার সাথে যে হিজির পাগলপারা প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে সে কথা হিজি ফ্লোরিডার বাবাকে বলেনি। ফ্লোরিডার বিরহে সে যে উম্মাদ হয়ে চুপিসারে সংগোপনে টলেডো গিয়েছিল সে কথাও প্রকাশ করেনি। সে জুলিয়নকে বলেছিল সিওয়াস্তার পরিবেশ এক ঘেয়েমী হয়ে উঠেছিল তাই সে ভ্রমণে বেরিয়েছিল। ফ্লোরিডার সাথে তার প্রেম, মুলাকাত, তার বিরহে অস্থির হয়ে টলেডো গমন, সেখানে ফ্লোরিডার সাথে একান্তে মিলন এবং ফ্লোরিডার প্রতি রডারিকের বাড়াবাড়ি, তাবৎ দাস্তান হিজি মুসার কাছে বর্ণনা দিল। যার বর্ণনা পূর্বে দেয়া হয়েছে।