এ ভিড়ের মাঝে কিছু লোক এখানে-সেখানে হাত পেতে বসেআছে। কারো কারো সামনে রয়েছে কাপড় বিছান, আবার অনেকের হাতে রয়েছে ঝুলি। এরা ভিখারী। তাদের কিছু সংখ্যক শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধি, তবে বেশীর ভাগই মরুভূমিতে বসবাসকারী গ্রম্য। হজ্জের মৌসুমে তারা মক্কায় এসে ভিক্ষা করে বেশ টাকা-পয়সা উপার্জন করে নিয়ে যায়।
হাজীরা তাদেরকে দান করেন। তাদের মাঝে কে ভিক্ষার উপযুক্ত আর কে উপযুক্ত না সেদিকে তারা লক্ষ্য করেন না। তারাতো আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। এ ভিখারীদেরকে দান করা হজ্জের অবশ্যপালনীয় কাজের একটা অংশ হিসেবে তারা জ্ঞান করেন।
ঐসব ভিখারীদের মাঝে আরো একজন ভিখারী এসে শামিল হয়েছিল যা কোন হাজী লক্ষ্য করেননি। লক্ষ্য করারই বা কি প্রয়োজন, অন্যান্য ভিক্ষুকদের মত সেও একজন ভিক্ষুক। এ নতুন ভিক্ষুকের মাঝে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। জীর্ণ-শীর্ণ বস্ত্র, হাতে-পায়ে ময়লা, দাড়িতে জমে রয়েছে ধূলাবালু, তার মাঝে যদি বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে তাহলে তা হলো সে অতিবৃদ্ধ ও ভীষণ দূর্বল, বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম নয়।
তার মাঝে আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল; যদ্বরুন মানুষ গভীরভাবে তাকে লক্ষ্য করছিল- তাহলো তার পায়ে শিকল, বুঝা যাচ্ছিল সে কয়েদী, বিশেষ অনুগ্রহ করে তাকে ভিক্ষার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তুমি কি কয়েদী? প্রথম দিনই একহাজী তাকে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, সে মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিল। তার চোখ দুটো ছিল-অশ্রুসজল।
“চুরি করেছ?”
“যদি চুরি করতাম তাহলে হাত কাটা থাকত। সে তার কম্পমান হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে জবাব দিল।
“কোন মহিলার সাথে জিনায় লিপ্ত হয়েছিলে?”
“এমন হলে তো আমি জীবিতই থাকতাম না, আমাকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা হত।” সে কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিল।
“তাহলে তুমি কি অপরাধ করেছ?”
“ভাগ্যের নির্মম পরিহাস” বৃদ্ধ ভিক্ষুক উত্তর দিল।
“অপরাধীদের ভাগ্য তাড়াতাড়ি বিপর্যয় ডেকে আনে, বুঝলে বুড়া!” পাশে দাঁড়ান অন্য আরেক হাজী বলল,
বুড়ো ভিখারীর চেহারায় বেদনার ছাপ ফুটে উঠল। তার আশে-পাশে দাঁড়ান লোকদেরকে অসহায় দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে লাগল।
অন্য আরেক হাজী বলল, “অপরাধী তার অপরাধের কথা স্বীকার করে না। জবাবে বুড়ো ভিক্ষুক বলল, “খলিফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক ইন্তেকাল করেছেন। আর তার জায়গায় তার ভাই সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক মসনদে বসেছেন। দামেস্কের বন্দী শালায় গিয়ে দেখ, আমার মত কয়েকজন বন্দী, নিরাপরাধী হয়েও অপরাধের শাস্তি ভোগ করছে।
এক হাজী জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে? তোমার নাম কি? তুমি কোন গোত্রের
প্রতি উত্তরে বুড়ো ভিখারী বলল, “এক সময় আমার নাম ছিল। এখনই নেই। নাম তো কেবল আল্লাহরই থাকবে, সে আকাশের দিকে ইশারা করে বলল, কেবলমাত্র আল্লাহর নামই বাকী থাকবে, কিছু দিলে তা আল্লাহকে দেবে। আল্লাহ তোমাদের হজ্জ কবুল করুন,আমি আমার অপরাধের কথা বলতে পারব না, অপরাধের কথা বলাটাও আমার অপরাধ হবে, তিনি যাকে ইচ্ছে সম্মান দান করেন, যাকে ইচ্ছে অপমানিত করেন।”
হাজীরা তাকে কিছু পয়সা দিয়ে চলে গেল। বুড়ো ভিখারী তার পায়ের শিকল কাপড় দ্বারা ঢেকে দিল। এ শিকলের কারণেই নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে। তার জবাব তার কাছেই আছে, কিন্তু জবাব দেয়ার সাহস নেই। সে খলীফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালেকের সাথে দামেস্ক থেকে এসেছে। মক্কাতে ভিক্ষা করানোর জন্যে তাকে বাদশাহর কাফেলার সাথে আনা হয়েছে। এটা তার শাস্তির একটি অংশ। সে সামনে হাত বাড়িয়ে চুপচাপ বসে থাকত। হাজীরা তাকে বৃদ্ধ মনে করে কিছু পয়সা-কড়ি বেশি দিত। কিন্তু সে তাতে খুশী হত না। এশার নামাজের পর হাজীরা যখন নিজ নিজ তাবুতে চলে যেত তখন সে যৎসামান্য পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খেয়ে সারা দিনের ভিক্ষার পয়সা গণনা করতে বসত। গণনা শেষে দুঃখ-কষ্টে তার অন্তর ব্যথিত হয়ে উঠত। দু’লক্ষ্য দিনার পূর্ণ করা তার জন্যে বড় প্রয়োজন। হজ্জের এ স্বল্প সময়ে এত পরিমাণ টাকা জমা করা তার পক্ষে সম্ভব না।
সে বুঝতে পারল, যেহেতু সে চুপচাপ বসে থাকে তাই পয়সা কম পায়। সে কথা বলা শুরু করল, কিন্তু অন্য ভিক্ষুকদের মত হৃদয় বিদারক সুরে চিৎকার করত না। আবার ছোট ছেলে-মেয়ের অনাহারের দোহায় দিয়ে ক্রন্দনও করতো না। সে শুধু একটা কথাই বলতো, “তিনি যাকে ইচ্ছে ইজ্জত দান করেন আর যাকে ইচ্ছে বেইজ্জতি করেন।
***
সে ভিক্ষা চাচ্ছিল, এক ব্যক্তি পিছন দিক থেকে এসে পা দিয়ে গুতো মারল, ভিখারী পিছন ফিরে দেখলো,
“পালাবার চিন্তে-ভাবনা করছ না তো বুড়ো?” গুতো দানকারী জিজ্ঞেস করল।
বুড়ো ভিখারী বললো, স্পেনের যুদ্ধের ময়দান থেকে কেউ পলায়ন করেছেন এমন কথা শুনেছ কি? আমি যদি পলায়নকারী হতাম তাহলে তো…।
“এখনো তোমার মাথা থেকে স্পেনের কথা বের হয়নি” আগত ব্যক্তি তাকে আরো একটা গুতো মেরে বলল।
বৃদ্ধ ভিক্ষুক বলল, তোমার খলীফাকে বলে দিও, তার রাজত্ব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে, মুহাম্মদ বিন কাসেমের হত্যাকারীকে আমার এ পয়গাম পৌঁছে দেবে। আর তোমার এ দুগুতোর জবাব কিয়ামতের দিন দিব।
গুতোদানকারী ভিক্ষুককে গভীরভাবে কড়া দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে, তিরস্কার করে চলে গেল।