কি হয়েছে ফ্লোরা! হিজি ঘাবড়িয়ে ভয়ার্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে তার কাছে গিয়ে বসল। নয়ন যুগল অশ্রু সাগরে ভাসিয়ে ফ্লোরিডা বলল, আমার কাছ থেকে দূরে থাক হিজি! আমার অপবিত্র কায়া স্পর্শ কর না, আমি তোমার উপযুক্ত নই। আমি আমার আত্মসম্মানী বাহাদুর বাবাকেও মুখ দেখানোর আর কাবেল নই। আমি আমার নিজেকেই ভর্ৎসনা করছি।
হিজি কম্পমান স্বরে বলল, কি হয়েছে তা খুলে বলতো ফ্লোরা!
ফ্লোরিডা তাকে পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করল।
ফ্লোরিডা ফুপাতে ফুপাতে বলল, আমার সতীত্ব-অনুঢ়ত্ব আমার সম্পদ ছিল। আমি নিজেকে কখনো শাহজাদী মনে করিনি। আমার যদি সম্রাজ্ঞী হবার অভিপ্রায় থাকতো তাহলে আমি আমার বাপের চারকের বেটার প্রেম সাগরে অবগাহন করতাম না।
ফ্লোরা! … হিজি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের নিচ থেকে খঞ্জর বের করে বললো, আমি বাদশাহর থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব। তাকে হত্যা করে এখান থেকে চলে যাবার কোশেশ করব। যদি ধরাও পড়ি তবুও কোন পরওয়া নেই। তোমার। ইযযতের ওপর আনন্দে জীবন বিলিয়ে দেব।
ফ্লোরিডা তার সম্মুখে দু’হাত সম্প্রসারিত করে বলল, না হিজি! তুমি তার কাছে পৌঁছুতে পারবে না, তার পূর্বেই পাকড়াও হয়ে যাবে। আমি তোমাকে উদ্দেশ্যহীন মৃত্যু গহ্বরে যেতে দেবনা। তুমি এক কাজ কর, কোন বাহানায় সবচেয়ে ভাল অশ্ব নিয়ে প্রত্যূষে শহরের ফটক খুলতেই তুমি বেরিয়ে যাবে। যত দ্রুত যেতে পার যাবে এবং সিওয়াস্তা পৌঁছে আমার বাবাকে এ ঘটনা শুনাবে। তাকে বলবে তিনি এসে যেকোন বাহানায় যেন আমাকে নিয়ে যান। শাহ্ রডারিকের কাছে এমন কিছু যেন প্রকাশ না পায় যাতে সে বুঝতে পারে যে বাবা এ ঘটনা জানে। বাবা যদি রডারিকের সামনে সামান্যতমও গোস্বা প্রকাশ করেন তাহলে এ হতভাগা দুস্কৃতকারী বাদশাহ্ তাকে কতল করে ফেলবে। আর আমাকে আজীবনের জন্যে তার মহলে বন্দি করবে। রডারিক আমাকে গুরুতর হুমকি দিয়েছে। বাবাকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে বলবে তা না হলে চিরতরে সিওয়াস্তা হারাতে হবে অধিকন্তু আমাদের খান্দানের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
***
প্রথম দিন যে অবাধ্য ঘোড়া দ্বারা হিজির ইমতেহান নেয়া হয়েছিল, অতি প্রত্যূষে সে ঐ ঘোড়ার ওপরে জিন লাগাল। হিজি তাকে বাহিরে দৌড়ানোর বাহানায় নিয়ে গেল। কেল্লার ফটক খুলাছিল। কেল্লা থেকে বের হয়েই সে ঘোড়াকে পদাঘাত করল, ঘোড়া হাওয়ার তালে ছুটে চলল, তার সামনে টলেডো থেকে সমুদ্র পর্যন্ত (যেখানে জাবালুত ত্বারে অবস্থিত) পাঁচশত মাইলের রাস্তা। এত পরিমাণ রাস্তা দৌড়ে অতিক্রম করা ঘোড়ার জন্যে অতীব কষ্ট সাধ্য। তারপরও গোয়েন্দার হাত থেকে বাঁচার জন্যে হিজি পূর্ণ দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ছিল।
অনেক দূর যাবার পর এক নদীর কুলে ঘোড়া থামিয়ে ঘোড়াকে পানি পান করাল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করার পর হিজি সাধারণ গতিতে ঘোড়া ছুটাল। রাতেও সে অবিরাম গতিতে সফর করছিল। যৎ সামান্য আরাম করা ছাড়া সারাক্ষণ, সফর করার ফলে দীর্ঘ পাঁচশত মাইল রাস্তা মাত্র চার দিনে অতিক্রম করল।
সম্মুখে সমুদ্র। সিওয়াস্তা যাবার জন্যে কোন কিশতী তৈরী নয়। দু’তিন দিনের মধ্যে কোন কিশতী সে দিকে যাবার ছিল না। এক পাল তোলা নৌকার মাঝিরা হিজিকে একা নিয়ে যাবার জন্যে এত পরিমাণ পয়সা দাবি করল যা তার কাছে ছিল না।
হিজি নৌকার মাল্লাদের উদ্দেশ্যে বলল, এ ঘোড়া তোমাদের কিশতীর চেয়ে অনেক কিমতী। এটা তোমরা রেখে দিয়ে আমাকে সিওয়াস্তার সীমানায় পৌঁছে দাও।
মাল্লা : আমরা মাঝি-মাল্লা। আমরা ঘোড়া কি করব। আমাদের নিজের ও ছেলে-পুলের পেটের অন্ন যুগাতেই আমরা অক্ষম। ঘোড়াকে খিলাব কোথা থেকে?
হিজিঃ এটা বিক্রি করে তোমরা তোমাদের পয়সা নিয়ে নিবে।
মাল্লা : আমরা ঘোড়ার সওদাগীরি সম্পর্কে ওয়াকিফ নই।
হিজি : তাহলে আমাকে বিশ্বাস কর। আমাকে নিয়ে চল, ওপার গিয়ে কেরায়ার পয়সাও দেব সাথে ইনয়ামও পাবে।
মাঝিরা তার সেকেল-ছুরত, শরীরের কাঠাম, পোষাক-পরিচ্ছেদ ও ঘোড়া দেখে তাকে অফিসার মনে করল ফলে ঘোড়াসহ তাকে কিশতিতে তুলে নৌকার পাল তুলে দিল।
সমুদ্র সফর ছিল বার মাইল। সূর্য মনি রক্তিম আভা ছড়িয়ে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় হিজির কিশতী সিওয়াস্তার তীরে গিয়ে ভীড়ল। হিজি মাল্লাদেরকে সাথে নিয়ে সোজা জুলিয়নের মহলে পৌঁছে ফটকের সিপাহীকে বলল, গভর্নর জুলিয়নকে অতি দ্রুত গিয়ে বল, আমি টলেড়ো হতে শাহ্জাদী ফ্লোরিডার জরুরী পয়গাম নিয়ে এসেছি।
জুলিয়ন তাকে তাৎক্ষণিক আহ্বান করল, কারণ সে তার বেটীর খবরের জন্যে বেকারার ছিল।
***
জুলিয়ন তাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল তুমি ফৌরইয়ারকের বেটা না?
হিজি : হ্যাঁ গভর্নর! আমি তার বেটা।
জুলিয়ন : তুমি কি টলেডো থেকে এসেছ? তোমার বাবাকে না বলে চলে গিয়েছিলে?
হিজি : জি হ্যাঁ। এখানে একঘেঁয়েমী লাগছিল তাই স্পেন সফরে বেরিয়ে ছিলাম। তবে মুহতারাম গভর্নর! আমার গায়েব হয়ে যাওয়া বা ফিরে আসা এটা আপনার জন্যে কোন জরুরী বিষয় নয়। আমি যে পয়গাম নিয়ে এসেছি সেটা খুবই জরুরী। আগে একটা আবেদন শুনুন। আমি যে কিশতীতে এসেছি তার কেরায়া দিতে পারিনি, মাল্লা সাথে এসেছে, তাকে কেরায়া দিতে হবে।