যে দিন রাত্রে হিজির বাগানে যাবার কথা ছিল, সেদিন বাদশাহ রডারিক চার পাঁচ দিনের গায়ের হাজিরীর পর ফিরে এসেছিল। স্পেনের কিছু এলাকাতে বিদ্রোহীয়া মাথা উঁচু করেছিল। বাদশাহ্ রডারিক নিজে সেখানে গিয়ে বিদ্রোহীদের তিন সর্দারের শিরোচ্ছেদ করে এসেছেন। সন্ধ্যায় এসে পৌঁছুলেন, তিনি ক্লান্ত-শ্রান্ত আবার খুশী কারণ বিদ্রোহীরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার পূর্বেই তা খতম করে দিয়েছে।
বাদশাহ্ ম্লান করে শরাব পানে বসলেন, তার আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল তিনি খুশীতে ফেটে পড়ছেন এবং তিনি স্থির করতে পারছেন না, খুশী তিনি কিভাবে উদযাপন করবেন। বাদশাহের মনে আনন্দ আনার জন্যে খুশী উদযাপনের জন্যে সাধারণতঃ দুটো জিনিস প্রাধান্য পায়, রমণী ও শরাব। বাদশাহ্ রডারিকের দরবারেও এ দু’জিনিসের কোন কমতি ছিল না। বাদশাহর দরবারে দু’তিন জন হাকীমও তার সাথে পনিরত ছিল।
মায়াবী, নবযৌবনা যে সব লাড়কীরা শরাব পান করাচ্ছিল তাদের দিকে দেখে বাদশাহ্ রডারিক বললেন, “কোন নতুন ফুল আছে? নাক ছিটকিয়ে নিজেই বললেন, নেই… কলি চাই, অর্ধ ফুটিত কলি।”
একজন হাকিম আদবের সাথে মুচকি হেসে বলল,এরাইতো ফুল, যারা স্পেনের বাদশাহর স্বপ্নিল নিলাভ ভূবনে খোশবু ছড়াচ্ছে।
বাদশাহ্ মাতালের সুরে বললেন, না! না! কলি চাই…। হাতে তুড়ি দিয়ে বললেন, ফ্লোরিডা… জুলিয়নের বেটী…।
বাদশাহর এক মুশির বলল, শাহান শাহে উন্দুলুস! বহিরাগত শাহজাদীরা আমাদের কাছে আমানত। তারা আদব-আখলাক শিখতেএসেছে। এখানে আগত শাহজাদীদের সাথে এ নাগাদ মামুলী কৌতুক-উপহাস পর্যন্ত করা হয়নি। এ সুনাম ক্ষুণ্ণ না করাই ভাল।
নিশাতে ঢুলতে ঢুলতে বাদশাহ্ বললেন, হাম উসে উন্দুলুস কা মালেকা বানায়েনগে। তুম সব চল যাও আওর ফ্লোরিডাকো ইহা ভেজ দো।
মুশির বলল, শাহান শাহে মোয়াজ্জম! বিপদের ব্যাপারে সতর্ক করা এবং মুসিবত থেকে আপনাকে বাঁচান আমার নৈতিক দায়িত্ব। যদিও এ দায়িত্ব আদায় করতে গিয়ে আমাকে প্রাণ দিতে হয়। হতে পারে ক্রোধান্বিত হয়ে আপনারই তলোয়ার কোষমুক্ত হয়ে আমার মাথা বদন থেকে জুদাহ করে দেবে, কিন্তু এতে আমার আত্মা শান্তি পাবে যে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।
শাহ্ রডারিক বললেন, কিসের বিপদ? জুলিয়নের পক্ষ হতে আমার ওপর আবার কি মুসীবত আসবে? প্রথমত হতে পারে তার বেটী ফ্লোরিডা আমার স্বপ্নীল ভূবনে রাত্রি যাপনকে বড় সম্মানজনক মনে করবে,দ্বিতীয়তঃ তা যদি না হয় তাহলে সে তার বাপকে বলবে, তারপর জুলিয়ন আমার কি করতে পারবে? দু ইঞ্চি জমিনের মালিক আমাদের বিশটা সোয়ারীর মুকাবেলা করার কাবেল নয়। তার তাকত তো আমি। যদিও সে আরবি ও বর্বরদেরকে সিওয়াস্তাতে বাধা দিয়ে স্পেনের দিকে আসতে দিচ্ছে না তার কারণ তো এটাই যে তার পিঠের ওপর আমার হস্ত রয়েছে। যদি আমার সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেই তাহলে আরব ও বর্বর মুসলমানরা তার কেল্লার প্রতিটি ইট চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তার দুই বেটীকে দাসী বানিয়ে নিয়ে যাবে। আমি যদি তার বেটীকে কিছু সময়ের জন্যে আমার খাবগাহতে অবস্থান করাই তাহলে তার খোশ হওয়া উচিৎ। হতে পারে আমি তার বেটীকে আমার রাণী বানাব।
মুশীর : শাহানশাহে মোয়াজ্জম! আমি শুধু এটা বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের তো শুধু দোস্ত পয়দা করা উচিৎ। দোস্তকে দুশমন বানানো উচিৎ নয়।
বাদশাহ্ রডারিক শাহী প্রতাপে বললেন, “তুমি কিছুই বুঝ না, যাও তাকে এখানে পাঠিয়ে দাও।”
শাহী প্রতাপ ও শরাবের নেশা, দুটো একত্রিত হয়ে রডারিকের মস্তিস্কের ওপর পর্দা ঢেলে দিয়েছিল। ছোট বাচ্চাকে বাবা ডাকলে যেমন খুশী ভরে দৌড়ে আসে ঠিক তেমনিভাবে আনন্দচিত্তে ফ্লোরিডা বাদশাহর খাবমহলে প্রবেশ করল। স্পেনের বাদশাহের আহ্বানকে সে হয়তো নিজের জন্যে মর্যাদাকর মনে করেছিল। কিন্তু সে কামরাতে প্রবেশ করার সাথে সাথে রডারিক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
ফ্লোরিডা বের হবার জন্যে বহুত চেষ্টা কোশেশ করল, ক্রন্দন করল, কিন্তু সেতো ছিল এক হিংস্র শক্তিশালী ক্ষুধাতুর হায়েনার থাবাতে। রডারিক কোনদিনও কল্পনা করতে পারেনি যে কোন মেয়ে তাকে এভাবে ভর্ৎসনা করতে পারে যে ভাবে ফ্লোরিডা ঘৃণা ভরে তাকে ভর্ৎসনা করছিল। রডারিক তাকে রাণী বানানোর লোভ দেখিয়ে ছিলেন কিন্তু ইযযত-আব্রু বিলিয়ে দিয়ে সে রানী হতে রাজী হয়নি।
রডারিক তাকে এ হুমকি দিয়ে ছিল যে, তিনি সিওয়াস্তার ওপর আক্রমণ করে তার বাবাসহ পুরো খান্দানকে টলেডোর অলি-গলিতে ভিক্ষা করতে বাধ্য করবে। ফ্লোরিডা বলেছিল, আসমান-জমিন সর্বত্র যদি আগুন লাগিয়ে দাও তবুও আমি আমার কুমারিত্ব খতম করতে পারব না।
স্পেনের ইতিহাসবেত্তারা সকলে এ ব্যাপারে ঐকমত্য যে ফ্লোরিডা কোন লোভে পড়েনি এমনিভাবে বাদশাহর কোন হুমকি-ধমকিকেও পাত্তা দেয়নি। সে তার কুমারিত্ব ও অনুঢ়ত্বের দোহায় দিচ্ছিল। কিন্তু শাহী প্রতাপ ও শরাব রডারিককে হিংস্র পশুতে পরিণত করেছিল। ফলে ষোল বছরের লাড়কী তার সতীত্ব ও কুমারিত্বকে হেফাজত করতে পারল না।
***
এটা ছিল রাতের প্রথম পহরের ঘটনা। অর্ধ রজনী অতিবাহিত হতেই হিজি বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে শাহী বাগিচার ঐ আঁধার প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুল যেখানে সে ইতিপূর্বে দু’বার গিয়েছিল। বাগানের প্রান্ত দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে ঐ জায়গায় উপস্থিত হলো যেখানে পূর্বে ফ্লোরিডার সাথে তার মিলন ঘটেছিল। ফ্লোরিডা তখনও আসেনি। তাকে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা ছায়া মূর্তি ক্রমে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কাছে আসতে আসতে তা এক রমণীল রূপ ধারণ করল। হিজি পূর্বের ন্যায় দু’তিন কদম তার দিকে অগ্রসর হলো কিন্তু ফ্লোরিডার চাল-চলনে বিন্দুমাত্র আবেগ ও আনন্দের ছোঁয়া ছিল না। প্রতিটি মিলন মুহূর্তের ন্যায় এবারও হিজি তার দু’হস্ত প্রসারিতকরে দিল কিন্তু ফ্লোরিডা তার বুকে যাওয়ার পরিবর্তে তা সজোরে সরিয়ে দিয়ে মুছা যাবার ন্যায় ঘাসের ওপর বসে পড়ল।