হিজী তার নওজোয়ান বেটা। ফ্লোরিডার বয়স যখন তের/চৌদ্দ বছর, হিজীর বয়স তখন সতের/আটার বছর। হিজীকে তার পিতা শৈশবেই শাহ সোয়ার বানিয়েছিলেন। নেজা বাজীতে সে পারদর্শী ছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে ফ্লোরিডার বাপ জুলিয়ন তার মেয়েকে ঘোড় সোয়ার বানানোর জন্যে হিজীর বাবাকে হুকুম করেছিলেন। ফ্লোরিডা সকাল-সাঁঝে ঘোড় সোয়ারের জন্যে যেত।
জুলিয়ন হিজীর বাপকে হিদায়াত দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আমার বেটীকে বেটী মনে করবে না। তুমি জান আমার কোন লাড়কা নেই। সম্ভবত এ কারনেই আমার এ লাড়কী লাড়কা হতে যাচ্ছে। সে আমার ছেলের অভাবপূরণ করবে। তাকে মর্দ মনে করে শাহ্ সোয়ার বানাবে এবং তাকে নেজা বাজী শেখানোর সাথে সাথে দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার ও কুঠার চালানোর তরবিয়াত দেবে।
দেড়-দুই মাহিনায় ফ্লোরিডা ঘোড় সোয়ারীতেএত পুখতা হয়ে গেল যে সে ঘোড়ায় সোয়ার অবস্থায় তার ঘোড়া বড় উপত্যকা ও উঁচু প্রাচীর লাফ দিয়ে অতিক্রম করতে লাগল। তার উস্তাদ তাকে একাকী দূরে যেতে দিতেন না। কিন্তু ফ্লোরিডা ছিল শাহজাদী, সে তার উস্তাদের ওপর হুকুমজারী করে ঘোড় নিয়ে চলে যেত।
উস্তাদ আশংকা করছিলেন, এ লাড়কী একাকী জঙ্গলে ঘোড়া নিয়ে গিয়ে কোন বাধার সম্মুখীন হয়ে যদি ঘোড়া হতে পড়ে যায় বা ঘোড়া যদি পড়ে যায় আর সে যদি ঘোড়ার নিচে পড়ে তাহলে তা উস্তাদের জন্যে বড়ই দুভাগ্য ডেকে আনবে। তাই উস্তাদ তার হাত থেকে বাঁচার জন্যে ফ্লোরিডা যখন ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে যেত তখন উস্তাদ তার ছেলে হিজীকে ঘোড়া দিয়ে তার পিছনে পাঠিয়ে দিতেন।
হিজীকে আপনার পিছনে বা সাথে দেখে ফ্লোরিডা কোন প্রশ্ন করেনি। একদিন সে পথিমধ্যে ঘোড়া দাঁড় করাল, হিজী তার কাছে গিয়ে তার নিজের ঘোড়াও, থামাল। ফ্লোরিডা তাকে দেখে মুচকি হাসি দিল। হিজীর মাঝে ছিল পৌরুষের সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের ছবি। তার শরীরের অব কাঠামো দেখে পরিষ্কার বুঝে আসছিল মর্দে ময়দান। তার মাঝে ছিল পুরুষকে যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ারের মাধ্যমে ব্যাকুল ও অস্থির করার ক্ষমতা আর মজলিসে রমণী পাগলপারা করার মোহ ও আকর্ষণ।
ফ্লোরিডা : হিজী! আমাকে ঘোড়া হতে নামিয়ে দাওতো। এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছি যে একা নামতে পারছিনে।
এটা শাহজাদীর হুকুম ছিল। তাই হিজী তৎক্ষণাৎ নিজ ঘোড়া হতে নেমে শাহজাদীর ঘোড়ার কাছে গিয়ে তার রেকাবের ওপর হাত রেখে দাঁড়াল। কিন্তু শাহজাদী দু’হাত প্রসারিত করে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে ক্ষণিকের মাঝে হিজীর বাহুবন্ধনে চলে এলো। হিজী তাকে মাটিতে দাঁড় করিয়ে পিছে হটছিল কিন্তু শাহজাদীর নরম-মাংসল বাহু যুগল হতে সে বেরুতে পারল না।
ফ্লোরিডা : ভয় পেওনা হিজি! তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে… খুব… ভাল লাগে।
“আমি তোমাদের এক গোলামের বেটা শাহজাদী!” হিজী কাঁপাকাঁপা গলায় বলল।
“গভর্নর জুলিয়ন যদি জানতে পারেন তাহলে….।”
ফ্লোরিডা : ভুল বুঝো না হিজি! আমি লাড়কী তো বটে তবে বৈশিষ্ট্য লাড়কীর নয়। আমি সেরেফ তোমার শরীর চাই না। তুমি কি সে মহব্বত সম্পর্কে ওয়াকিফ নও যার জন্ম হৃদয়ে এবং হৃদয়ের গভীরেই বাসা বেধে থাকে?
হিজি : না! শাহজাদী না!
ফ্লোরিডা : আমাকে শাহজাদী বলবে না। আমাকে মহব্বত করার নির্দেশ আমি তোমাকে দিচ্ছিনে… আমাকে ফ্লোরা বলবে।
***
হিজি ফ্লোরা বলতে লাগল। শাহজাদী শাহী প্রাচীর ও আঙ্গিনা ডিঙ্গিয়ে এলো। লোক সম্মুখে হিজি ছিল তার নওকর কিন্তু কেল্লার বাহিরে খোলা প্রান্তরে ছিল তার প্রিয়জন ও হৃদয় সুজন। প্রথম দিন ফ্লোরিডা তাকে বলে ছিল আমি কেবল তোমার শরীর চাই না, তা সে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিল। তার মহব্বত দিল হতে জন্ম নিয়ে অন্তরের গভীরতম প্রদেশে ঠাঁই করে নিয়েছিল।
হিজি তাকে শাহ্ সোয়ার বানিয়ে নেজাবাজী ও তলোয়ার চালনেও মাহের বানিয়ে দিল। ফ্লোরিডার বাবা-মা বিন্দুমাত্রও অনুভব করতে পারলানা যে, তাদের বেটী নি জিন্দেগীর সাথী ইন্তেখাব করে নিয়েছে। ফ্লোরিডা ও হিজি কখনো চিন্তা করেনি যে তাদের শাদী আদৌ হবে না। জুলিয়ন মখমলের নকশা চটের থলীতে করবেন না। তারা তো প্রেমের সাগরে ডুবদিয়ে নিজেদের অবস্থার কথাই কেবল ভুলেনি বরং তামাম দুনিয়াকেই ভুলে গিয়েছিল।
সময়ের ঘড়ি অতিক্রম করে দু’ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন মা ফ্লোরিডাকে বললেন তার বাবা তাকে টলেডো নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে তাকে কমছে কম একবছর স্পেনের বাদশাহ রডারিকের শাহী মহলে অতিবাহিত করতে হবে।
ফ্লোরিডা : কেন?
মা : তুমি কি জান না, শাহী খান্দানের লাড়কীরা সেখানে শাহী আদব-আখলাক ও বাদশাহী চাল-চলন শিখতে যায়?
ফ্লোরিডা : আমি মূর্খ-গ্রাম্য? আমি শাহী তরীকা সম্পর্কে ওয়াকিফ নই? আমার কিসের কমতি পরিলক্ষিত হচ্ছে?… আমি যাব না, আমিঐ শাহী খান্দান সম্পর্কে অনেক কথা-বার্তা শুনেছি। শাহী মহলে যে আদব-আখলাক প্রচলিত রয়েছে তার কয়েকটা ঘটনা আমি শ্রবণ করেছি।
ফ্লোরিডার মা তাকে অনেক বুঝালেন কিন্তু তার কোন কথা শ্রবণ করল না, সে এক কথায় বলতে লাগল ঐসব বাদশাদের কাছে কোন আখলাক, ভদ্রতা, শিষ্টাচার কিছুই নেই। কিন্তু তার বাবা যখন হুকুমের স্বরে তাকে স্পেনে যেতে বললেন তখন আর সে অস্বীকার করার সাহস পেল না। সে জানত তার বাবা কি পরিমাণ স্বেচ্ছাচারী।