জুলিয়ন অত্যন্ত স্পৃহা ও তেজস্বীভাবে বললেন, আমীরে মুসা! এটা এমন তলোয়ার যা কখনো নত হয়নি। সে দুশমনের উঁচু ও উন্নত গর্দান ওয়ার করেছে। বেয়াদবী মনে করবে না-মুসা! তাকাববরী ও অহংকার ভাববে না, এটা ঐ তলোয়ার যাকে তুমিও নত করতে পারনি। তোমার বর্বর ফৌজও তার ঝলকানী দেখে সিওয়াস্তার কেল্লার পিছু হটে ছিল। আজ সে তলোয়ার তোমার পদযুগলের নিচে পড়ে রয়েছে। কোন বাদশাহ্, কোন সেনাপতি এত সহজে তার তলোয়ার নিজের দুশমনের কদমের নিচে রাখে না কিন্তু তুমি আমার দুশমন নও। এখন আমারা ভাই ভাই একে অপরের দোস্ত। আজকে এক বন্ধু তার দুঃখ অপর বন্ধুর হৃদয়ে ঢালার জন্যে এসেছে… তা কি গ্রহণ করবে মুসা!
মুসা ইবনে নুসাইর নিচু হয়ে পায়ের নিচ থেকে জুলিয়নের শমসের উঠিয়ে নিজ হাতে জুলিয়নকে অর্পন করলেন।
মুসা : তুমি আমাকে দোস্ত ও ভাই বলেছ এটা শুনে খুশী হলাম। আমি তোমার তলোয়ারের কদর করি। মুসা নিজ তলোয়ার কোষবদ্ধ করে বললেন, এখন কি আমার দোস্ত তার অন্তরের ব্যথার কথা আমাকে বলবে?
জুলিয়ন : হ্যাঁ। যা শোনানোর জন্যে এসেছি তা শুনিয়ে যাব। যদি আমীরে মুসার বেটীকে কেউ বেআব্রু করে তাহলে মুসা তাকে কি শাস্তিদেবে?
প্রতি উত্তরে মুসা বললেন, অভিযোগ প্রমাণিত হবার পর অপরাধীকে প্রস্তরাঘাতে খতম করে দেয়া হবে।
জুলিয়ন : অপরাধী যদি কোন মুলুকের বাদশাহ্ হয়?
মুসা : তাহলে মুসা তার শাহী তখতের ইট চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে আর সে বাদশাহর খানদানের তামাম আওরতকে দাসী বানিয়ে নিয়ে আসবে।
জুলিয়ন : আর সে মাজলুম বেটি যদি তোমার দুশমনের হয়?
মুসা; সে মাজলুম বেটী এবং তার বাপ যদি ফরিয়াদী হয়ে আসে তাহলে মুসা তারও প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হবে যে তার নিজের সালতানাত কোন খতরার মাঝে পড়ে কি না!
জুলিয়ন : না মুসা! তোমার সালতানাত ও প্রসাদ কোন খতরায় পড়বেনা। বরং তোমার সালাতানাত আরো প্রশস্ত হবে… এখন শোন মূসা! সে মাজলুম পিতা, আমি, নির্যাতিতা আমার বেটী।
মুসা : তারপরও তোমার তলোয়ার কেন কোষবদ্ধ? এবং তোমার তলোয়ার কেন আমার পদযুগলে পড়ল?
জুলিয়ন : এজন্যে যে অপরাধী আমার চেয়ে বেশী তকতওয়ালা আর সে হলো স্পেনের বাদশাহ্ রডারিক।
মুসা : রডারিকের শাহী মহলে তোমার বেটী কিভাবে গেল?
জুলিয়ন : আমীরে মুসা! বেশক আমি বাদশাহ্ রডারিকের জায়গীরদার, কিন্তু আমার সম্পর্ক স্পেনের শাহী খান্দারের সাথে। কোন এক সময় আমার এ রাজ্য স্বাধীন ছিল, সময়ের প্রেক্ষিতে সিওয়াস্তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব স্পেনের বাদশাহ্ নিয়ে নেন এবং সিওয়াস্তা স্পেনের অংশে পরিণত হয়। আমি বাদশাহ্ থেকে হলাম গভর্নর। শাহী খান্দানের রেওয়াজ রয়েছে যে, যার মেয়ে পনের-ষোল বছরে পদার্পন করে তখন তার বেটীকে স্পেনের শাহী মহলের আদব-কায়দা, শিষ্টাচার শেখানোর জন্যে শাহী মহলে পাঠিয়ে দেয়। শাহী পরিবারের লোকরা অনেক সময় তার দশ বার বছরের মেয়েকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়…….
সে দস্তুর মুতাবেক আমি আমার বেটী ফ্লোরিডাকে বাদশাহ্ রডারিকের কাছে পাঠিয়ে ছিলাম। তার বয়স সতেরর দোড় গোড়ায় পৌঁছেছে। যেহেতু মেয়েদের আদব-তরবিয়ত শিক্ষা দেয়া হয় এ কারণে তাদেরকে শাহী মহলে আওরতের নেগরানীতে রাখা হয়। পুরুষের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকে না। আমার বেটী খবর পাঠিয়েছে, বাদশাহ্ রডারিক থোকা দিয়ে তার ইযযত হরন করেছে।
মুসা : তোমার বেটী এখন কোথায়?
জুলিয়ন : আমি তাকে টলেডো হতে নিয়ে এসেছি, তুমি হয়তো জানো টলেডো স্পেনের রাজধানী। এখন আমার বেটী সিওয়াস্তাতে। ইচ্ছে করলে আমার বেটীকে এখানে তলব করে জিজ্ঞেস করতে পার।
মুসা ইবনে নুসাইর! আমার বেইযতির প্রতিশোধ আমি রডারিক থেকে নিতে চাই। তার এক তরীকা তো এই যে, তাকে আমি কতল করে ফেলব। কিন্তু এটা সম্ভব বলে মনে হয় না। সে বহুত কম বাহিরে বের হয়। যদি বের হয় তাহলে তার চতুর পার্শ্বে মুহাফিজের ভিড় জমে থাকে।
দ্বিতীয় তরীকা যার কথা চিন্তে করে তোমার কাছে আমি এসেছি তাহলে তুমি স্পেন আক্রমণ কর আমি তোমাকে পূর্ণ মদদ করব। তবে আমি সামনে আসব না। বেশক স্পেনে ফৌজ বেশুমার। সংখ্যার দিকে যদি লক্ষ্য কর তাহলে তুমি হামলা করতে পারবেনা তবে যে উদ্দীপনা ও নিয়মতান্ত্রিকতা তোমার ফৌজের মাঝে রয়েছে তা রডারিকের সৈন্যের মাঝে নেই এর তাফসীল আমি পরে করব। আমি ইয়াকীনের সাথে বলছি তোমার ফৌজ স্পেনের ফৌজকে শেকান্ত দিবে। আমার প্রতিশোধ কেবল রডারিকের হত্যার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না বরং তার বাদশাহীকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চাই। আমার এই ইরাদা কেবল তুমিই পূর্ণ করতে পারো। তবে এর পরিপূর্ণ ফায়দা তোমার হবে। আমি কেবল এ আবেদন করব যে তুমি সিওয়াস্তাকে আযাদ রাখবে।
***
এটা একটা মাশহুর ওয়াকিয়া যা ঐতিহাসিকরা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, জুলিয়নের দুই বেটী ছিল। একজনের নাম ছিল ফ্লোরিডা অপরজনের নাম ছিল মেরী। ফ্লোরিডা যত বড় হচ্ছিল তত তার সৌন্দর্য মাধুর্য রূপলাবণ্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
তারা বলতেন, আমার বেটী যে সুন্দর হয়ে গড়ে উঠছে তার জন্যে তো ঐ রকম সুন্দর শাহজাদা পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে। তার মা জানতেন যে, তার বেটী চৌদ্দ বছর বয়সেই এক শাহজাদাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। যাকে বেছে নিয়েছে প্রকৃত অর্থে সে শাহজাদা নয়। সে শাহী আস্তাবলের এক শাহ সোয়ারের বেটা। এই শাহ্ সোয়ার শাহী খান্দানের ও ফৌজী অফিসারদের আওলাদেরকে ঘোড় সোয়ারী ও নেজাবাজী প্রশিক্ষণ দেন। শাহী খান্দান ও ফৌজের উঁচু পর্যায়ে তার, বেশ মর্যাদা, কদর রয়েছে।