মুসা : সালতানাতে ইসলামীর সাথে আপনার কি সম্পর্ক? আর আপনার স্বজাতি, স্বগোত্রের বাদশাহ রডারিকের সাথেই বা আপনার কি দুশমনি?
জুলিয়ন : আপনি কি জানেন না যে আমি বাদশাহ রডারিকের জায়গীরদার? সে আমাকে আপনার রাস্তায় প্রতিবন্ধক বানিয়ে রেখেছে। সে সব সময় এ আশংকায় আছে যে, আরবের মুসলমান এত মক্তিশালী যোদ্ধায় পরিণত হয়েছে যে তারা পারস্য-রোম সম্রাটকে পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আজ তারা আফ্রিকার উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বর্বরজাতিকেও তারা ইসলামে দাখিল করে ফৌজি বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছে ফলে সে ভয় পাচ্ছে, এখন মুসলমানরা স্পেন হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করবে।
মুসা : আপনি কি স্পেন ও আমাদের মাঝে একটা আযাদমুলক হিসেবে থাকতে চাচ্ছেন?
জুলিয়ন : সে কথা পরে হবে, আগে আপনি আমার পূর্ণ কথা শ্রবণ করে আমার এক সওয়ালের জওয়াব দেন। আপনি কি স্পেনের ওপর হামলা করে সুন্দর ও শ্যামল রাজ্যকে আপনার বিশাল সালতানাতের মাঝে শামিল করবেন?
মূসা : না, আমার কাছে এত পরিমাণ সৈন্য নেই। কেন্দ্র থেকে সৈন্য সাহায্য পাবার আশা নেই, ফলে স্পেনের মত অত বড় ফৌজি বাহিনীর ওপর হামলা করার ক্ষমতা আমার নেই।
মুসা ইবনে নুসাইর অসত্য কথা বললেন, তিনি বহুবার স্পেনের ওপর হামলার ইরাদা করে পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। তিনি তার সেনাপতিদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে ছিলেন এবং তিনি এটা চাচ্ছিলেন যে খলীফা যেন তাকে স্পেন আক্রমণের অনুমতি দিয়ে দেন। সে সময় খলীফা ছিলেন ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালেক, তিনি সব সময় যুদ্ধ করে অন্যান্য মূলুককে ইসলামী মুলুকে শামিল করার ফিকিরে থাকতেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে তিনি সিন্দু আক্রমণে পাঠিয়ে ছিলেন। মুসা তার নিজের একটা কমজোরীর কথা চিন্তে করতেন তাহলে আরবরা তখন পর্যন্ত নৌ যুদ্ধে দক্ষ হয়ে উঠতে পেরে ছিল না। জাহাজ চালনায় তারা মাহের ছিল কিন্তু নৌ যুদ্ধের কিছু কলাকৌশল ছিল যে সম্পর্কে তখনও তারা নাওয়াকিফ ছিল। স্পেন ও আফ্রিকার মাঝে প্রাচীর হিসেবে ছিল সাগর, স্পেনে হামলার সময়ে স্পেনের জংগী জাহাজ তাদেরকে সমুদ্রের মাঝে বাধা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু মুসলমানরা সাগরে যুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না।
জুলিয়নকে মুসা জবাব দিলেন, স্পেনের ওপর হামলা করার কোন চিন্তাই তার নেই। তিনি সন্দেহ করেছিলেন, সে এ তথ্য নিতে এসেছে যে, স্পেনের ব্যাপারে মুসলমানদের চিন্তা-ফিকির কি। তিনি জুলিয়নের ব্যাপারে এ শুবাহও করেছিলেন যে সে মুসলমানদের অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে এসেছে। মুসলমানরা যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে তাহলে তাদের ওপর হামলা করে তাদের আফ্রিকা ও মিসর হতে। বিতাড়িত করা হবে।
জুলিয়ন : আপনি হয়তো জানেন না যে, স্পেন কুতরতের এক ঈর্ষনীয় মুলুক। চারিদিকে সুবজ নয়নাভিরাম ক্ষেত, ঘন সন্নিবিশিষ্ট্য গাছ-পালা, পত্র-পল্লব, এত সৌন্দর্য মণ্ডিত যে যদি মৃত ব্যক্তিও দেখে তাহলে সে জীবিত হয়ে উঠবে। স্পেন সমুদ্র ও নদী প্রধান দেশ। তা সবুজ-শ্যামল পাহাড় ও মনোহরী উপত্যাকার মুলুক। সেথাকার মাটি সোনা, ফলায়। মাটির নিচে রত্নভান্ডার লুকিয়ে আছে। আপনি যদি সেখানে যান তাহলে আরবের বালুময় ও আফ্রিকার পাথুরী জমিনের দিকে ফিরে থাকাবেন না…
সেখানের মানুষ সৌন্দর্যের প্রতীক, সেখানের রমণীদের সৌন্দর্য যাদুর আবেশে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। আপনি জান্নাতের কথা শুনেছেন যা মৃত্যুর পরে পাওয়া যাবে। কে পাবে কে পাবে না তা মালুম নেই। আপনি যদি স্পেনে যান তাহলে বলে উঠবেন এটাই সে জান্নাত যার ওয়াদা আল্লাহ্ তা’য়ালা করেছেন। আমীরে আফ্রিকা আপনি কি চিন্তে করছেন? স্পেনের দরজা আমার হাতে আমি তা খুলে দেব।
ঐতিহাসিকরা লেখেন, স্পেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম দৃশ্যের কথা জুলিয়ন এমন চিত্তাকর্ষণ শব্দ ও ভঙ্গিতে বর্ণনা করেন যে মুসা ইবনে নুসাইরের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু তিনি দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, তিনি খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের যাদুময়ী কথা ও চিত্তহরী বক্তৃতার ধোকা সম্পর্কে ওয়াকিফ ছিলেন। তিনি ইশারা করলেন, সবাইকে বাহিরে চলে যাবার জন্যে। কামরার মাঝে মুসা জুলিয়ন ও দুভাষী রয়ে গেল।
মূসা : জুলিয়ন! তুমি আমার জন্যে খুব সুন্দর জাল বিস্তার করছো। তুমি আকলের উপর এত পরিমাণ নির্ভরশীল যে এটা চিন্তে করার কাবেল তুমি নও যে, যার কাছে যাদুময়ী বক্তৃতা দিচ্ছ সে অনেক ময়দানের খেলোয়াড়, তার চোখের তীক্ষ্ণতা মাটির নিচ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুতে পারে।
জুলিয়ন : বেশক আমীরে মুসা! আমি এসব কিছু চিন্তে করেই এসেছি। আমি আপনার শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনি আমাকে ছোট ভাই মনে করে “তুমি” বলে সম্বোধন করেছেন। অনুমতি দিন আমিও আপনাকে তুমি বলে সম্বোধন করি। সে হাত দুটো মুসার দিকে প্রসারিত করে বলল, “আমার অন্তরের বন্ধুত্ব গ্রহণ করুন এবং আমার দিলে যা লুকিয়ে আছে তাও শ্রবণ করুন।”
মুসা ইবনে নুসাইর তার প্রসারিত হস্তদ্বয় জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ পর জুলিয়ন তার হাত মুসার হাত থেকে বের করে উঠে দাঁড়ান। তিনি অত্যন্ত ক্ষীপ্ততার সাথে তলোয়ার কোষমুক্ত করেন। তার চেয়ে আরো বেশী দ্রুত মুসার হাত তার কুরসীর সাথে রাখা তলোয়ারে গিয়ে পৌঁছে। কিন্তু জুলিয়ন তলোয়ার দু’হাতের তালুর ওপর নিয়ে দাঁড়িয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে মুসার সামনে ঝুঁকে পড়ে তলোয়ার মুসার কদমের কাছে রেখে দিয়ে পিছনে কিছুদূর সরে এসে দাঁড়ালেন।