মুসা দু’বার দূত মারফত পয়গাম পাঠিয়ে ছিলেন জুলিয়নের কাছে যে, সে যেন শান্তিতে থাকে এবং অন্যকে শান্তিতে থাকতে দেয় তাহলে তাকে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। জুলিয়ন উভয় পয়গামের জবাব দিয়ে ছিল কিন্তু তার মাঝে তুচ্ছ তাচ্ছিলভাব ছিল।
উভয় বার জওয়ারী পয়গামে জুলিয়ন বলেছিল, হে ইসলামী সালতানাতের আমীর! সিওয়াস্তাকে অবরোধ করার পূর্বে স্পেনের ফৌজের হিসেব করেন যাতে পরে পছতে না হয়।
এত বড় প্রকাশ্য দুশমন মুসার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। মুসা তাকে অন্দরে আনার নির্দেশ দিলেন।
***
দু’তিন জন মুশির ও দু’জন সেনাপতিসহ মুসা যে কামরায় বসা ছিলেন জুলিয়ন শাহী লেবাছে বাদশাহী ঢং এ সে কামরাতে প্রবেশ করল। তাকে দেখে মুসা উঠে দাঁড়ালেন এবং হাসিমুখে মুসাফাহার জন্যে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিলেন। জুলিয়ন তার ভাষায় কি যেন বলল, দু’ভাষী তার তরজমা করে দিল,
“আমি নিরাপদে এসেছি এবং নিরাপদে প্রস্থান করব। বন্ধুত্বের পয়গাম নিয়ে এসেছি এবং বন্ধুত্বের ভান্ডার নিয়ে ফিরে যাব।”
মুসা ইবনে নুসাইর জুলিয়নকে বুকে জড়িয়ে ধরে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আমাদের ঘরে যদি কোন চরম দুশমনও আসে তাহলে তাকে আমরা দোস্ত মনে করি। আপনার দিলে যত বড়ই খারাপ ইরাদা থাকুক আমরা আপনাকে দোস্তই মনে করব।
তরজুমান উভয়ের কথাবার্তা বর্বর জবানে তরজমা করে শুনাচ্ছিল। জুলিয়নের সাথে চমকদ্বার পোশাক পরিহিত নেজাহ্ হাতে দুরক্ষি ছিল, তারা আধো বন্ধ আধো খোলা দরজার সামনে দাঁড়ান ছিল। জুলিয়ন তাদেরকে ইশারা করলে তারা রোবটের মত বুকে সালাম করে চলে গেল।
তারা চলে যাবার পর দু’জন কৃষ্ণকায় আদমী যাদের মাথায় সফেদ টুপি আর পরনে ঝলমলে তহবন্দ। তারা দু’জন একটা বাক্স নিয়ে এসে তা মুসা ইবনে নুসাইরের সামনে রেখে ঢাকনা খুলে দিয়ে তারা নতজানু হয়ে মুসার সামনে সিজদায় পড়ে গেল। তারা সিজদা থেকে উঠে নিচু হয়ে পিছন ফিরে চলে গেলে সাথে সাথে এরকম আরো দু’জন হাবশী গোলাম ঐ রকম বাক্স নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
মুসা : আমীরে সিওয়াস্তা! আপনি এদেরকে বলেদেন এরা যেন আমার সামনে সিজদা না করে।
জুলিয়ন : আমীরে সালাতানাতে ইসলামীয়া! এরা গোলাম, শাহী খান্দানের আফরাদ নয় ফলে তাদেরকে সিজদা করতে বাধা দেবেন না।
মুসা : আমীর জুলিয়ন! আমরা সকলেই গোলাম। আমরা একজন বাদশাহের সামনে কেবল সিজদাবনত হই। মুসা শাহাদত আঙ্গুল আসমানের দিকে তুলে ইশারা করে বললেন, আর সে বাদশাহ হলেন আল্লাহ! এসব আদব-কায়দার পাবন্দী আপনি আপনার দরবারে করবেন, আমরা সকলে এখন আল্লাহর দরবারে বসে আছি। মুসা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কখনো মুসলমানদেরকে একত্রে নামাজ পড়তে দেখেননি।
জুলিয়ন : দেখে ছিলাম আমীরে আফ্রিকা! যখন আপনার সৈন্য বাহিনী সিওয়াস্তা অবরোধ করেছিল সে সময় একদিন সন্ধ্যায় কেল্লার প্রাচীরের উপর গিয়ে আপনার তামাম ফৌজকে এক ব্যক্তির পিছনে কাতার বন্দি হয়ে নামাজ পড়তে দেখেছিলাম।
মূসা : আপনি কি কিছু বুঝতে পেরে ছিলেন? সেনাপতি-সেপাহী, আলা আদনা, সফেদ সিয়া-রাজা-প্রজা সকলে একত্রে দাঁড়ান ছিল। সেখানে এমন কোন কানুন ছিলনা যে কর্মকর্তা সামনের কাতারে আর কর্মচারী পেছনে। ইসলামে মনিব ও গোলামের মাঝে কোন ইমতিয়াজ নেই। আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে সকলে সমান হয়ে যায়। মানুষ মানুষের সামনে নত হওয়া ও সিজদা করা ইসলামে বড় পাপের কাজ।
তিনটি বাক্স কামরার ভেতর আনা হলো। মুসা ইবনে নুসাইর নিষেধ করার পরও বাক্স আরোহনকারীরা নত হয়ে সিজদা করছিল আর জুলিয়ন তা দেখে মুচকি হাসছিল।
জুলিয়ন যা এনেছিল তা অত্যন্ত মূল্যবান হাদিয়া-তুহফা ছিল।
জুলিয়ন : আমীরে আফ্রিকা মুসা ইবনে নুসাইরের জন্যে একটি ঘোড়াও নিয়ে এসেছি। তা বাহিরে রয়েছে। শাহী আস্তাবলের ঘোড়া, এত দ্রুতগামী যেন উড়ে চলে। কেবল মাত্র শাহী লোককে তার পিঠে চড়তে দেয়। আবার লাগাম ধরার সাথে সাথে থেমে যায়। কয়েকটা ময়দানে যুদ্ধ করেছে। যেন শাহী আস্তাবলের বাদশাহ।
মুসা : আমি নিজের পক্ষ হতে এবং খলিফাতুল মুসলিমীনের পক্ষ হতে শুকরিয়া আদায় করছি। আপনি কি এখন আপনার তাশরীফ আনার মাকসাদ বলবেন?
***
তিনজন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক~ লেইন পোল, প্রফেসর দুর্জী ও স্যার মেক্যুয়েল, মুসা ইবনে নুসাইর ও জুলিয়নের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল তা তারা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন।
জুলিয়ন : আমীরে আফ্রিকা ও মিশর! আমি আপনার জন্যে আরো একটি তুহফা নিয়ে এসেছি তবে সে তুহফা আপনাকে নিজে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গ্রহণ করতে হবে, আমি আপনার সাথে থাকব, পথিমাঝে কৃষ্ণসাগর বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমি আমার পথ প্রদর্শক প্রেরণ করব।
মুসা : আমাদের দিলের লুক্কায়িত বিষয় তো কেবল আল্লাহ জানেন। এক তো আপনার আগমনের বিষয়টাই আমার বোধ ক্ষমতার উর্ধ্বে তারপর আপনি তুহফার কথা বলছেন এবং যে আঙ্গিকে বলছেন তা অনুধাবনের শক্তিতো আমার একেবারেই নেই। আপনি আপনার শরীফের মাকসাদ ও মানশা এমনভাবে বর্ণনা করবেন না যা আমার মত কম আকলের লোকের অনুধাবন করতে কষ্ট হয়।
জুলিয়ন : সেই তুহফার নাম স্পেন। স্পেন একটা দেশ যে ব্যাপারে আপনি না ওয়াকিফ নন। আপনি ঐ মুলুককে ইসলামী সালতানাতের মাঝে শামিল করতে পারেন। সামনে ফ্রান্স। আপনি স্পেনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফ্রান্সকেও অধীনে আনতে পারেন।