বর্বরদের বিষয়টা তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, অনেক সময় এ বিষয়টা নিয়ে পেরেশান হয়ে পড়তেন।
বর্বররা উত্তর আফ্রিকার বাসিন্দা ছিল। লড়াকু নির্ভীক এক জাতি। তাদের ইতিহাস যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মারদাঙ্গার এর বিশাল উপাখ্যান। বিভিন্ন জাতি তাদের ওপর আক্রমণ করেছে কিন্তু পরিণামে তারা নিজেদের পুরো সৈন্য বাহিনী নিঃশেষ করে ফিরে গেছে, যদিও কেউ তাদের ওপর বিজয়ার্জন করেছে কিন্তু সে বিজয় খুব স্বল্প সময়ই ধরে রাখতে পেরেছে। বর্বরা বিদ্রোহ করে বিজয়ীদের চলে যেতে বাধ্য করেছে। রোম রাজ্যের মত বড় শক্তি তারা রক্ত সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। হিসপাহানিকরা এসেছে তারাও রোমদের মত এমন পরাজিত হয়েছে আর কোনদিন বর্বরদের অভিমুখি হওয়ার কল্পনা করেনি।
বর্বরদেরকে যদি কেউ পরাজিত করে থাকে তাহলে আরবের মুসলমানরাই করেছে। কেবল পরাজিত করলেই সবশেষ হয় না, আসল কাজতো শুরু হয় পরাস্ত করার পর, তাহলো বিজীতদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। প্রথম পর্যায় বর্বরদের ওপর মুসলমানের যারা আমীর নিযুক্ত হয়েছিলেন তারা বর্বরদেরকে নিচু শ্রেণীর ও দাঙ্গাবাজ জাতি মনে করে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করেননি। বর্বররা অবাধ্য জাতি ছিল। তাদের পৃথক ধর্ম ও সংস্কৃতি ছিল। তারা মুসলমানদের ধর্মগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিদ্রোহ করতে থাকে।
মুসা ইবনে নুসাইরের পূর্বে যিনি আমীর ছিলেন তিনি বর্বররা অধিনস্ত ও দাস, এ মনোভাব পরিহার করে তাদেরকে শহরের ব্যবস্থাপনা ও সৈন্য বাহিনীতে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। তাদেরকে বড় বড় পদ মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রদান। করে ইসলামী সমতা মূলনীতির আলোকে তাদেরকে আরবী সভ্যতা সংস্কৃতিকে অভ্যস্ত করে তোলেন। তবে সমস্যা হলো এ কারণে যে, বর্বররা আরবের গ্রাম্যদের মত গোত্রকে আঁকড়ে ধরে ছিল, প্রত্যেক গোত্রের পৃথক পৃথক সর্দার ছিল আর প্রতিটি গোত্রছিল স্বাধীন। এ কারণে তাদের সকলকে একটি জাতি হিসেবে একত্রিত করা যাচ্ছিল না। কিছু গোত্র আনুগত্য স্বীকার করলে বাকীরা হয়ে উঠত বিদ্রোহী। তাসত্ত্বেও আমীরের সদ্ব্যবহার ও তাবলীগে মুগ্ধ হয়ে বর্বররা ইসলাম গ্রহণ করতে ছিল।
তারপর মুসা ইবনে নুসাইর আমীর হিসেবে আগমন করেন। তিনি এসেই বর্বরদের একটা পৃথক ও নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। মুসা প্রতিটি গোত্রে স্বয়ং নিজে গিয়ে কার্যক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা ও সভ্যতা সম্পর্কে অবহিত করেন। যেখানে শক্তি প্রয়োগ করা প্রয়োজন সেখানে শক্তি প্রয়োগ করেন তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের অস্ত্র ব্যবহার করেন। স্বল্প কিছু দিনের মাঝে সকলে মুসলমান হয়ে যায়।
আমীরে মুসা ইবনে নুসাইর বর্বর ফৌজকেও আরবীদের ন্যায় শৃংখলাবদ্ধ করেন। বর্বররা লড়াকু তো ঠিকই ছিল কিন্তু যুদ্ধ বিদ্যা ও যুদ্ধ ময়দানের নিয়ম কানুন সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল না। তারা হত্যা-লুণ্ঠন ও দুশমনদের বসতি ধ্বংস সাধনে, ছিল অভ্যস্ত। মুসা তাদেরকে ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের নিয়ম শৃংখলা ও কমান্ডারের হুকুমে যুদ্ধ করার নীতিতে আবদ্ধ করেন।
এটা মুসা ইবনে নুসাইরের অবদান যে, তিনি সকল বর্বর গোত্রকে এক জাতিতে পরিণত করেছিলেন তবে প্রত্যেক গোত্রের সর্দারের সর্দারী বাকী রেখেছিলেন। ফলে তারা স্পৃহায় আরবদের সমপর্যায়ে পৌঁছে ছিল।
***
একদিন মুসা ইবনে নুসাইর উত্তর আফ্রিকার তানজানিয়া শহরে অবস্থান করছিলেন। তাকে খবর দেয়া হলো সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়ন তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে এসছে। জুলিয়ন! অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে মুসা বললেন, সে খ্রীষ্টান গভর্নর, আমার সাথে কি উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ করতে চায়?
তার সাথে আরো কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছে। খবর দাতা জবাব দিল, তাদেরকে শাহী মহলের লোক বা বড় কোন গভর্নর বলে মনে হচ্ছে, তারা কিছু উপঢৌকন নিয়ে এসেছে।
মুসা বললেন, খোদার কসম! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আর কেউ কি এটা বিশ্বাস করতে পারে, যার সাথে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে এবং যার সাথে আমাদের দুশমনি রয়েছে সে হঠাৎ করে আমাদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছে? না,. এটা হতে পারে না, সম্ভবতঃ সে সন্ধির ফন্দি করতে এসেছে। আমি তার ফন্দির জালে পা দেব না।
মুসার এক গভর্নর বলল, আমীরে মুহতারাম! সে এত দূর হতে এসেছে, তাকে মুলাকাতের মওকা দিন।
সিওয়াস্তা একটা বড় শহর সমপরিমাণ রাজ্য যা জাবালুত তারেক (জিব্রালটাল)-এর বিপরীতে রোম সাগরের পাড়ে আফ্রিকার সীমান্তে অবস্থিত ছিল। তাকে ইউরোপের প্রবেশ দ্বার বলা হতো। সিওয়াস্তা রাজ্য ও জাবালুত্ ত্বারেকের মাঝে যে সাগর ছিল তার প্রসস্ত ছিল বার মাইল। সিওয়াস্তা স্পেনের বাদশাহ রডারিকের তত্ত্বাবধানে ছিল। রডারিক তার ফৌজ সিওয়াস্তার গভর্নর জুলিয়নকে দিয়ে ছিল অধিকন্তু জুলিয়নের নিজস্ব ফৌজও ছিল।
জুলিয়ন যেহেতু রডারিকের মত শক্তিধর বাদশাহর তত্ত্বাবধান ও মদদ পাচ্ছিল এ কারণে সে তার সৈন্যবাহিনী দ্বারা আশে-পাশের এলাকা কবজা করার কোশেসে রত ছিল। আমীরে আফ্রিকা মুসা তাকে শায়েস্তা করার জন্যে কয়েকবার সৈন্য প্রেরণ করেছেন ফলে মুসা ও জুলিয়নের মাঝে বেশ কয়েকবার লড়াই হয়েছে। দু’তিনবার মূসা পূর্ণ দমে হামলা করিয়েছেন, কিন্তু সিওয়াস্তার কেল্লা এত মজবুত ছিল যে তা দখলে আনা সম্ভব হয়নি। জুলিয়নের ফৌজকে কেল্লার মাঝে বন্দি করে রাখার জন্যে মুসা কেল্লার চতুষ্পর্শে বর্বর সৈন্য মুতায়েন করেছিলেন এবং এ এলান করেছিলেন যে জুলিয়নের ফেত্না চিরতরে খতম করার জন্যে তিনি পূর্ণদমে হামলা করবেন এবং অবরোধ দীর্ঘায়িত করে কেল্লার ফৌজ ও অন্যান্য লোকদেরকে ক্ষুধা পিপাসায় কতর বানিয়ে জুলিয়নকে মজবুর করবেন আত্মসমর্পণে। এ অবস্থায় রডারিকের সৈন্য বাহিনী যার সংখ্যা দুলাখেরও বেশি, জুলিয়নের মদদে এগিয়ে আসার আশংকা ছিল।