সে সময় আব্দুল আজীজ স্পেনের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, একজন নায়েবে সালারের মাধ্যমে দারুল খেলাফত ও বায়তুল মালের জন্যে দামেস্কে পাঠালেন।
নায়েবে সালার দামেস্কে পৌঁছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব সম্পদ ও কিছু তুহফা সুলায়মানের দরবারে পেশ করল।
সুলায়মান : স্পেনের কি অবস্থা কেমন চলছে সেখানকার হুকুমত?
সালার : হুকুমত তো ঠিকই চলছে আমীরুল মু’মিনীন! কিন্তু হুকুমতের পরিচালক ঠিকমত চলছে না।
সুলায়মান : পরিষ্কারভাবে সব কিছু খুলে বল। মনে হচ্ছে সেখানে এমন কিছু হচ্ছে যা হওয়া সমীচীন নয়।
সালার; আমীরুল মু’মিনীন! আপনার এ প্রশ্নের জবাব স্পেনে এ সময় যেসব সালার ও গভর্নর রয়েছে তারা দিচ্ছেন। তারা আমাকে এ দায়িত্বও অর্পন করেছেন আমি যেন স্পেনের সকল অবস্থা আপনাকে অবগত করি। স্পেনে এখন এক অমুসলিম রমণী রাজত্ব করছে।
সুলায়মান : এ রমনী সে নয়তো, যে খ্রীষ্টান আওরতের সাথে আব্দুল আজীজ ইবনে মুসা শাদী করেছে সে রমনী হয়তো এখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি?
সালার : সেই আমীরুল মু’মিনীন। তার নাম ইঞ্জেলা। আমীর আব্দুল আজীজ তাকে রানী বানিয়ে রেখেছেন। সে বড় বড় হাকিমদেরকেও আমীরের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয় না। সেখানে বাদশাহদের মত দরবার বসে এবং কর্তৃত্ব চলে ইঞ্জেলার।
সালার সকল বিষয়ের বিবরণ দিল ছোট দরজার কথাও বলল।
সালার : সেখানের একজন অফিসার, কর্মকর্তাও আমীরের ওপর খুশী মন। খুশী অখুশী বড় কথা নয় তবে বড় কথা হলো সেখানের সালার, ফৌজ ও শহরবাসী যে কোন সময় আমীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। তারা সকলেই উত্ত্যক্ত।
খলীফা সুলায়মান আর কিছু শুনতে চাইলেন না। রাগে গর্জে উঠলেন। মুসার খান্দানের কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সামান্যতম বাহানার প্রয়োজন ছিল তা তিনি পেয়ে গেলেন। খলীফা আগে থেকেই রেগে ছিলেন, মুসা তার ছেলেকে আমীর নিযুক্ত করে এসেছেন।
সুলায়মান; তুমি চলে যাও। সকলকে বলবে তাদের এ অভিযোগ আমি মিটিয়ে দেব।
***
একদিন আমীরে স্পেন আব্দুল আজীজের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ এভাবে খতম হলো যে, এক সকালে আব্দুল আজীজ ফজর নামাজের ইমামতির জন্যে দাঁড়িয়েছেন। সূরা ফাতিহা পড়ে সূরা ওয়াকিয়া সবেমাত্র শুরু করেছেন এরি মাঝে এক ব্যক্তি সামনের কাতার থেকে দ্রুত সামনে অগ্রসর হয়ে মুহূর্তের মাঝে তলোয়ার বের করে এক কোপে আব্দুল আজীজের শিরুচ্ছেদ করল। কোন নামাজীরা বিষয়টা বুঝে উঠার পূর্বেই ঘাতক আমীরে স্পেনের শির নিয়ে উধাও হয়ে গেল।
বিশ-পঁচিশ দিন পর মখমল আবৃত চামড়ার থলেতে আব্দুল আজীজের মস্তৃক সুলায়মানের দরবারে এসে পৌঁছল।
সুলায়মান নির্দেশ দিলেন, আমীরে স্পেনের শির কয়েদখানাতে নিয়ে গিয়ে তার বাপ মুসার সম্মুখে রেখে দাও।
সুলায়মানের নির্দেশ মুতাবেক আব্দুল আজীজের মস্তক কয়েদখানায় মুসার সম্মুখে রাখা হলো। মুসা পূর্বেই অমানবিক নির্যাতন, গঞ্জনা ও দুঃখে কণ্ঠে ভেঙ্গে পড়ে ছিলেন। ছেলের মাথা দেখে মুছা গেলেন। চেতনা ফিরে পেয়ে দেখলেন সেখানে মস্তক নেই।
মুসা ছেলের মাথা দেখে বলেছিলেন,
“তারা এমন ব্যক্তিকে হত্যা করল যে ন্যায় পরায়নতা ও ইনসাফের সাথে দিনে করত রাষ্ট্র পরিচালনা আর রাতের বেলা করত আল্লাহর ইবাদত।… আমার ছেলে কায়েমুল লাইল ও সায়েমুন নাহার তথা রজনীতে সালাত সমাপনকারী ও দিবসে রোজা পালনকারী ছিল।”
মুসার এ কথার সত্যায়ন ইতিহাসেও পাওয়া যায়। কিন্তু আব্দুল আজীজ অনুধাবন করতে পারলেন না যে কোন রমনীকে পিঠে সোয়ার করলে মেধা বুদ্ধিতেও সে সোয়ার হয়। সে এটাও বুঝতে পারলেন না যে রমনীরাই বাদশাহদের সিংহাসন করেছে ভূলণ্ঠিত, বহুদেশ করেছে বরবাদ। এ ভুল আব্দুল আজীজ থেকে হলো কিছু তার জ্ঞাতসারে আর কিছু অজ্ঞাতসারে।
মুসা ইবনে নুসাইর তার ছেলের কর্তিত শির দেখার পর, মাত্র কয়েকদিন জীবিত ছিলেন। ৭১৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি তিনি পরলোকে পাড়িজমান। তার এক বছর পরই সুলায়মানও বিদায় নেন।
জুলিয়ন পুনরায় সিওয়ান্তা (মরক্কো) এর গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
দশম শতাব্দীতে আবু সুলায়মান আইয়ুব নামে একজন বড় আলেম অতিবাহিত হয়েছেন, তিনি জুলিয়নের বংশধর ছিলেন।
এক ইহুদী যাদুকর বলেছিল, স্পেন ভূমি রক্ত চেয়েছে এবং চাইতেই থাকবে, খুন প্রবাহিত হয়েছে এবং হতেই থাকবে। তার একথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মুসা, তার ছেলে কতল হয়েছেন, কতল হয়েছেন মুগীছে রূমী। তারপর মুসলমানদের আটশত বছরের স্পেনের ইতিহাসে রক্তই প্রবাহিত হয়েছে। একের পর এক আমীর হয়েছে নিহত, সিংহাসন হয়েছে রক্তে রঞ্জিত। এভাবে খুন-খারাবী পরস্পরে চলতে থাকে; যার পরিণামে একদিন স্পেন ইসলামী জগত হতে বেরিয়ে চিরতরে হাত ছাড়া হয় মুসলমানদের।