ইবনে মহাল্লাব : ধন্যবাদ ইবনে নুসাইর! আমি যা বললাম তাই তুমি করবে এটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি তোমার অভিপ্রায় জানতে চাচ্ছিলাম। খলীফা সুলায়মানের সাথে যাতে তোমার মীমাংসা হয়ে যায় এ ব্যাপারে এখন আমি চেষ্টা করব।
সে সময় মুসা যা বলেছিলেন তা আজও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মুসা বললেন, ইবনে মহাল্লাব! জলজ প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি এত প্রখর হয় যে, নদী ও সমুদ্রের তলদেশের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর জিনিস দেখতে পারে কিন্তু তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে যে জাল পাতা হয় তা সে দেখতে পায় না। আমি দূরদর্শী ছিলাম। কিন্তু সুলায়মানের ফাঁদে ফেঁসে গেছি।
তারপর মহল্লাব মুসা ইবনে নুসাইরের বিজয় গৌরব তুলে ধরে সুলায়মানের কাছ থকে তাকে মুক্ত করার বহুত কোশেশ করল কিন্তু সুলায়মান পাথরের মত তার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলেন, মুসাকে ক্ষমা করলেন না।
সে সময় মুগীছে রূমী কতল হলেন। তাকে কে কতল করল তা সুস্পষ্ট জানা না গেলেও, দলীল-প্রমাণ দ্বারা বুঝা যায় সুলায়মানই তাকে কতল করিয়ে ছিলেন।
সুলায়মান খেলাফতের বাগডোর হাতে নিয়েই ইসলামের গৌরবান্বিত ব্যক্তিদেরকে কতল করেছিলেন।
ভারতবর্ষে ইসলামের পতাকা উড্ডীনকারী, সিন্ধু বিজেতা মুহাম্মদ ইবনে কাসেমকে সুলায়মান দামেস্কের এ কয়েদখানাতে বন্দী করে অমানবিক নির্যাতন নিপীড়নের পর নির্মমভাবে হত্যা করে ছিলেন।
সমরকন্দ বিজেতা কুতায়বা বিন মুসলিমকে সুলায়মান দামেস্কের কারাগারে কতল করে ছিলেন।
ইয়যীদ ইবনে আবু মুসলিম ইরাকের গভর্নরকে সুলায়মান বন্দি করে ছিলেন।
সুলায়মানের কোন বন্ধু থেকে থাকলে তা ছিল ইবনে মহাল্লাব। তার পূর্ণনাম হলো ইয়াযীদ ইবনে মহাল্লাব। ধন-সম্পদ বিনষ্টকারী ও বিলাসী ব্যক্তি ছিল। সে বায়তুল মালের ষাট হাজার দেরহাম তসরফ করেছিল। হাজ্জাজ এ অপরাধে তাকে কয়েদ করেছিলেন, কিন্তু সে কয়েদ খানা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর হাজ্জাজের ইন্তেকালের পর সে ফিরে আসে পরে সুলায়মান তাকে পূর্ব পদে বহাল করেছিলেন এবং বলেছিলেন, “মহাল্লাবের সন্তানের প্রতি কেউ চোখতুলে তাকাতে পারবে না।” এ দ্বারা অনুমেয় যে সুলায়মান যেমন দুষ্ট প্রকৃতির ছিলেন তেমনি ধরনের লোককে তিনি বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন।
তারেক ইবনে যিয়াদ এদিক থেকে বড়ই সৌভাগ্যশালী ছিলেন। তিনি সুলায়মানের হাতে নিহত হননি। সম্ভবত এ কারণে যে, তারেক ছিলেন বর্বর, সুলায়মানের সাথে তার কোন খান্দানী দুশমনি ছিল না এবং তার সাথে নেতৃত্বের ব্যাপারে কোন জটিলতা ছিল না যা ছিল হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের সাথে। খলীফা মুসা ও তারেককে ইনয়াম দিয়েছিলেন কিন্তু সুলায়মান মুসাকে সে ইনয়াম হতে বঞ্চিত করেছিলেন। পক্ষান্তরে তারেককে আরো টাকা-পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন বাকী জিন্দেগী ঘরে বসে অতিবাহিত করুন।
ইতিহাসে পাওয়া যায় না তারেক ইবনে যিয়াদ বাকী জীবন কোথায় কাটিয়েছেন। দামেস্কেই ছিলেন না আফ্রিকা চলে গিয়েছিলেন। ইতিহাস কেবল এতটুকু বর্ণনা করে যে, সুলায়মান তার পরে তারেককে আর কোন লড়াইএ শামিল করেননি। স্পেন বিজেতা যিনি স্পেন সীমান্তে গিয়ে কিস্তী জ্বালিয়ে দিয়ে ছিলেন যাতে ফিরার চিন্তা মাথায় না আসে, তার মত মহান ব্যক্তিত্ব ইতিহাসে হারিয়ে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু মুসলমানরা তার নাম কিভাবে বিস্মৃত হবে যাকে স্বয়ং রাসূল (স) স্বপ্নে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তার নাম বিস্মৃত হবার বদলে এমনভাবে, ঝলকে উঠেছে যে আজ ইসলামী জগতের আনাচে কানাচে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ। কোন অমুসলিমও যদি স্পেনের কথা আলোচনা করে তাহলে তারেক ইবনে যিয়াদের নাম- কেবল স্মরণ নয় বরং অকৃপণতার সাথে তাকে জানায় সাধুবাদ।
***
মুসা ইবনে নুসাইর কয়েদ খানায় মৃত্যুর প্রহর গুন ছিলেন। অপর দিকে তার ছেলে আব্দুল আজীজ আমীরে স্পেন, সে মুকের লোকদের অবস্থা পরিবর্তন করছিলেন। আব্দুল আজীজ ছিলেন দুনিয়া বিমুখ, রাসূল কারীম (স)-এর আশেক। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও ইসলামী বিধি অনুপাতে মুসলমান ও খ্রীস্টানদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি করে উভয়কে এক জাতিতে পরিণত করেছিলেন।
স্পেনে বেগার ও গোলামী পদ্ধতি চালু ছিল। সেখানকার খ্রীস্টান ও ইহুদী আমীর-ওমারারা দরিদ্র কৃষক-মজদুরকে অন্ন-বন্ত্রের বিনিময় গোলামের মত ব্যবহার করত।
এসব দরিদ্র লোকরা জমিক্রয় ও বাড়ী বানানোর অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। আব্দুল আজীজ এ নির্যাতন মুলক প্রথার বিরুদ্ধে নির্দেশ জারীর পরিবর্তে ঘোষণা দিলেন, যেসব মজদুর ইসলাম গ্রহণ করবে সে বেগার খাটা ও গোলামীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে এবং সে জমি ও বাড়ীর মালিকত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তার এ ঘোষণা এত ফলপ্রসু হলো যে অতিদ্রুত মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। ইহুদী ও খ্রীস্টানদের উপাসনালয় দিন দিন বিরান হতে লাগল। নতুন নতুন মসজিদ তৈরী হতে লাগল। স্পেনের কিছু শহরে সেকালের মসজিদ এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
আব্দুল আজীজ স্পেনের নিগৃত-লাঞ্ছিত মানবতা উদ্ধার করলেন। প্রতিটি মানুষকে দিলেন তার প্রাপ্য মর্যাদা। খ্রীস্টানদের ধর্ম, তাদের উপাসনার ব্যাপারে কোন প্রকার বাধা সৃষ্টি করলেন না, তবে পাদ্রীরা ধর্মের আড়ালে যেসব অপকর্মের বীজ বপন করেছিল, তা তিনি খতম করে দিলেন। এমনিভাবে বড় পাদ্রী যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিল তা মিটিয়ে দিলেন।