এটা অত্যন্ত গুরুতর অন্যায় নির্দেশ ছিল যার অনুমতি শরীয়ত আদৌ দেয়নি। মুসার বয়স আশির দোড় গোড়ায় পৌঁছে ছিল। কোন প্রকার কষ্ট ভোগ করার। ক্ষমতা তার ছিল না। কিন্তু প্রখর রৌদ্রে তপ্ত বালুর ওপর তাকে শুইয়ে দেয়া হতো। কোন সময় প্রচণ্ড রৌদ্রের মাঝে একটা থামের সাথে বেঁধে রাখা হতো। খলীফা, ওয়ালীদ মুসাকে যে মুদ্রা দিয়ে ছিলেন তা সমুদয় এবং মুসার ব্যক্তিগত তাবৎ সম্পত্তি সুলায়মান বাজেয়াপ্ত করেছিলেন যার ফলে তার খান্দানের লোকরা অনাহারে অর্ধহারে থাকতে ছিল, তারা দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জন্যে মজদুরী করতে লাগল।
এরপরও সুলায়মানের প্রতিশোধের আগুন ঠান্ডা হয়নি। দেড় বছর পরে যখন মুসাকে বিলকুল চেনার উপায় ছিল না। সুলায়মান হজ্জে গিয়ে ছিলেন তখন পায়ে শিকল পরিয়ে মুসাকেও সাথে নিয়ে গিয়ে ছিলেন। ভিক্ষে করার জন্যে তাকে সাত সকালে কা’বার সম্মুখে বসিয়ে দেয়া হতো। সারাদিন মুসা হাজীদের কাছে ভিক্ষে, চায়তেন সন্ধ্যেবেলা সুলায়মানের লোকরা তাকে সেখান থেকে নিয়ে যেত। সারা দিনের ভিক্ষের পয়সা তার থেকে নিয়ে নেয়া হতো। সুলায়মান তার ওপর জরিমানা নির্ধারণ করেছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল ভিক্ষে করে সে জরিমানার টাকা পরিশোধ করবে, পূর্ণ টাকা শেষ হলে তাকে মুক্ত করা হবে।
এ হলো এক স্পেন বিজেতার পরিণাম। তারেক ইবনে যিয়াদ ও মুগীছে রূমীর সাথে যে ব্যবহার করেছেন তা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় কিন্তু মুসার বীরত্ব-সাহসীকতা, বুদ্ধিমত্তা, বিজয় সফলতা এত বেশী ছিল যে তিনি ক্ষমা পাবার যোগ্য ছিলেন। মুসা জীবনের পুরোটা যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়ে ছিলেন।
তিনি বর্বরদেরকে আরবদের তুলনায় নিচু জ্ঞান করেছিলেন ঠিক কিন্তু এটাও তার সফলতা ছিল যে তিনি বর্বরদের মত অবাধ্য কওমকে এক পতাকাতলে একত্রিত করে ছিলেন। বর্বররা কোন দিন কারো আনুগত্য স্বীকার করেনি। মুসাই এক মাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি তাদেরকে দামেস্কের খেলাফতের অনুগত করেছিলেন। তারেক ইবনে যিয়াদ তারই হাতে গড়া সিপাহ্ সালার ছিলেন যিনি যৎ সামান্য সৈন্য নিয়ে স্পেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে স্পেন অতিক্রম করে ফ্রান্স পর্যন্ত ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন করেছিলেন।
মুসার ব্যক্তিত্ব নিম্নের ঘটনা থেকে ফুটে উঠে।
একদা সুলায়মান মুসাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। সে সময় আমীর ইবনে মহাল্লাব তথায় উপস্থিত ছিল। যে ছিল মুসার মঙ্গলকামী ও সুলায়মানও তাকে মান্য করতেন। সে সুলায়মানকে বলল, মুসাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্যে। সুলায়মান ইবনে মহাল্লাবের কথা মত তাকে হত্যার হাত থেকে রেহায় দিলেন কিন্তু মাফ করলেন না। মহাল্লাব গোস্বান্বিত হয়ে কয়েদ খানায় গিয়ে দেখতে পেল মুসা রৌদ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তার মাথা ঘুরছে, তারপর কিছুক্ষণ পরেই মুসা মাটিতে পড়ে গেলেন।
তাকে কুটরীতে নাও, পানি পান করাও। মহাল্লাব নির্দেশ দিল। মুসাকে উঠিয়ে কামরাতে নিয়ে গিয়ে তার মুখে পানি দেয়া হলো এবং চেহারাতে পানির ছিটা দেয়া হলো তখন তিনি সম্বিৎ ফিরে ফেলেন।
। আমাকে চিনতে পারছ ইবনে নুসাইর! মহাল্লাব জিজ্ঞেস করল, মুসা বড় কষ্টে .চোখ খুলে বললেন,হ, তুমি আমার বন্ধু ইবনে মহাল্লাব- তুমি কি আমাকে মুক্ত করতে এসেছ না কি দেখতে এসেছ আমি কবে মৃত্যু বরণ করব?
মহাল্লাব : আজকেই তুমি মৃত্যুবরণ করতে, সুলায়মান তোমাকে কতলের হুকুম দিয়ে ছিলেন। তোমার জীবন আমি রক্ষা করেছি কিন্তু তোমার সে ঘোরতর শত্রু, তোমাকে ক্ষমা করেনি। তোমার বিবেক-বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছিল ইবনে নুসাইর। আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তুমি খলীফার আহ্বানে কেন এখানে এলে? তোমার যোগ্যতা ও বীরত্বের নজীর কেউ পেশ করতে পারবে না তোমার নজীর কেবল তুমিই। তুমি জানতে খলীফা অসুস্থ এবং এমন দুর্বল হয়ে পড়েছেন সুস্থতা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়, তুমি এটাও অবগত ছিলে ওয়ালীদের পরে তার ভাই সুলায়মান খেলাফতের মসনদে সমাসীন হবেন আর তিনি তোমার দুশমন। তোমার বিরুদ্ধে তার একটা বাহানার প্রয়োজন ছিল তা তিনি পেয়ে গেছেন।
মুসা : আমি না এলে ওয়ালীদ অত্যন্ত রাগান্বিত হতেন। তার হুকুম ছিল বড় কঠোর।
ইবনে মহাল্লাব : তুমি না আসতে। তুমি একটা মুলক বিজয় করে ছিলে, তারেক ইবনে যিয়াদ, মুগীছে রূমী ও অন্যান্য সালাররা তোমাকে কেবল আমীর নয় তারা নিজের পিতা মনে করত। তাছাড়া তোমার কাছে ছিল একদল যুদ্ধবাজ ও লড়াকু সৈন্য। ধন-সম্পদও কম ছিল না। তারপরও তুমি দামেস্কের জাহান্নামে কেন এলে? স্পেনের স্বাধীন সুলতান হয়ে যেতে, দামেস্ক থেকে কোন খলীফা তোমার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাতেন না। মাঝখানে সমুদ্র ছিল বড় বাধা।
মুসা : ইবনে মহালাব! আমি পাপী তবে আমীরুল মু’মিনীনের নির্দেশ অমান্যকারী পাপী হতে চাইনি। তারেক ইবনে যিয়াদ আমার হুকুম অমান্য করার দরুন তাকে আমি বেত্রাঘাত করে ছিলাম। আমাদের বিজিত প্রতিটি দেশের আমীর যদি কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনভাবে চলার চিন্তা ভাবনা করে তাহলে ইসলামী সালতানাত হবে চূর্ণ-বিচূর্ণ, উম্মতে মুহাম্মদের মাঝে আসবে পরিবর্তন আর ইসলাম কেবল মক্কার মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।