– মুসা ইবনে নুসাইরের কাফেলা বেশ বড় ছিল। সম্মুখভাগে ছিলেন মুসা, তারেক ও মুগীছে রুমী। তার পিছনে ছিল দু’শ আড়াইশ প্ররিতক্ষা ঘোড় সোয়ার। তাদের পশ্চাতে ছিল হাজার হাজার কয়েদী। তাদের মাঝে রডারিকের উচ্চ পর্যায়ের অফিসাররাও ছিল। তবে তাদের মাঝে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল কর্ডোভার গভর্নর, সে ছিল মুগীছে রুমীর বিশেষ কয়েদী। কাফেলার সাথে ঘোড়ার গাড়ীও ছিল, তাতে ছিল বাদী-দাসী।
কাফেলা শহর হতে দেড় মাইল দূরত্বে পৌঁছলে রাস্তার দুপাশে জনতার ভিড় দেখা গেল। শহরবাসীর সামনে মুসলমান লস্কররা সাদা পোষাক পরিহিত হয়ে বর্শার মাথায় সবুজ পতাকা বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সাদা-পোষাক ও সবুজ পতাকা অত্যন্ত মনোরম দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। ফৌজের পিছনে ছিল শহরবাসী। তাদের মহিলা ও শিশু-কিশোরকে সম্মুখে রাখা হয়েছিল। তারা সকলে হাত নেড়ে নেড়ে “আমীরে মুসা ইবনে নুসাইর খোশ আমদেদ, মুসা ইবনে নুসাইর জিন্দা-বাদ” শ্লোগান দিচ্ছিল। জওয়ান লাড়কীদের কাছে ছিল ফুলের ঝুড়ি তারা মুসার চলার পথে ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
মুসা নিচের দিকে চেয়ে মৃদু হাসছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিকরা লেখেন, তারেক ও মুগীছে রুমীর চেহারাতে অপছন্দের ছাপ ফুটে উঠেছিল।
তারপর তারা যখন শহরের সিংহদ্বারে পৌঁছেন তখন সেখানে তাদেরকে যে ইস্তেকবাল করা হলো তার শানই ছিল ভিন্ন। শহরের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা তাদের প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। মুসা এবং তার সাথীরা ঘোড়া হতে অবতরণ করলে তারা সম্মুখে এগিয়ে এসে মুস্ম, তারেক ও মুগীছে রূমীর সামনে ঝুঁকে তাদের হাত চুম্বন করল।
মোটকথা ইঞ্জেলা মুসাকে অন্যান্য বাদশাহদের মত সম্মান প্রদর্শন করল।
***
রাতে ইঞ্জেলা তার স্বামীকে বলল, আজীজ! তুমি তোমার মহান পিতাকে কেন সাধারণ মানুষ জ্ঞান করছ? তোমার পিতা শাহান শাহ্ আর তুমি হলে শাহজাদা। তোমার বাবাকে আমি শাহান শাহর মর্যাদা প্রদর্শন করছি।
ইঞ্জেলা অসাধারণ সুন্দরী ছিল। তার চেয়েও সুন্দরী রমনী ছিল কিন্তু তার মাঝে এমন এক যাদু ছিল, যার বলে সে রডারিকের মত শক্তিধর বাদশাহকে মোম বানিয়ে ফেলেছিল আর আব্দুল আজীজের মত মর্দে মু’মিনকে হাতের মুঠে নিয়ে নিয়েছিল।
মুসা ইবনে নুসাইর ইসাবালাতে বেশীদিন অপেক্ষা করলেন না। সেখানে তিনি একটা কাজই করলেন তাহলে আব্দুল আজীজকে স্পেনের আমীর নিযুক্ত করে তাকে সর্বোপরি ক্ষমতা প্রদান করলেন। আব্দুল আজীজ যে দিন আমীর নিযুক্ত হলো সেদিন ছিল ইঞ্জেলার জন্যে সবচেয়ে খুশী ও আন্দঘন দিন। এমন আনন্দময় সময় তার জীবনে আর কোনদিন আসেনি। এমন কি সে যখন রডারিকের বিবি হয়েছিল তখনও না। কারণ রডারিকের বিবি সে ঠিকই হয়েছিল কিন্তু রানীর কর্তৃত্ব ছিল অন্যের হাতে। সে রানীর কর্তৃত্ব ও মর্যাদা পায়নি। এখন সে আব্দুল আজীজের বিবি, রানীর পূর্ণ কর্তৃত্ব তার হাতে।
ইসাবালাতে একত্রিত মালে গণীমত, খলীফার জন্যে তুহফা ও কয়েদীদেরকে দামেস্কে নিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত করালেন।
মুসা একদিন ইসাবালা হতে জাবালুত্ তারেকের দিকে রওনা হলেন। তার দূরত্ব ছিল তিনশ মাইলের কিছুটা বেশী। রাস্তাতে কয়েকটি পল্লী ও তিন-চারটি শহর সম্মুখে এলো। কাফেলা যে পল্লী ও শহরের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল তারা ইসাবালার মত রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কাফেলাকে ইস্তেবাল করছিল। এর দ্বারা মুসা দেখাতে চাচ্ছিলেন তিনি যেভাবে স্পেন বিজয় করে খলীফার কাছে যাচ্ছেন ঠিক তেমনিভাবে তিনি স্পেনের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন।
কাফেলার সাথে ত্রিশ হাজার কয়েদী ছিল। এমনিভাবে ঘোড়ার গাড়ীতে ছিল অসংখ্য দাসী-বাদী। এরা ছিল ঐসব রমণী যারা স্বেচ্ছায় মুসলমানদের সাথে যেতে রাজী হয়েছিল। এসব রমণীদের মাঝে ছিল দাসী, আমীর-ওমারা ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা। তারা সকলেই স্বেচ্ছায় মুসলমানদের সাথে যাচ্ছিল। বিপুল পরিমাণ মালেগণিত খচ্চর ও গাড়ীতে বোঝায় ছিল।
বেশি দীর্ঘদিন পর এ কাফেলা জাবালুত তারেক (জিব্রালটাল) এ পৌঁছল। সেখানে জাহাজ-নৌ অপেক্ষমান ছিল। মুসাকে অভিভাদন জানানোর জন্যে লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল। স্পেনের বহু নামী-দামী লোক জাবালুত তারেক পর্যন্ত এসেছিল মুসাকে বিদায় সম্ভাষণ জ্ঞাপন করার জন্যে।
জাহাজ-নৌকা বহর আফ্রিকা উপকুল কায়রো গিয়ে ভিড়ল। কায়রো মিশর ও আফ্রিকার রাজধানী ছিল। দু’একদিন সেখানে অবস্থান করে মুসার কাফেলা দামেস্কের দিকে রওনা হলো। সেখানে আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, কয়েকজন বর্বর সর্দার ও বেশ কয়েকজন মিশরী সে কাফেলাতে শামিল হলো। তারা মুসা ইবনে নুসাইরকে বেষ্টনি দিয়ে এগিয়ে গেল। এখন খচ্চরের পরিবর্তে উটের পিঠে করে মাল-সামান নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। উটগুলোকে রংগিন কাপড়ে নয়নাভিরাম করে সাজান হয়েছিল।
কাফেলা কত দিনে দামেস্কে পৌঁছল তা কোন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেননি। রাস্তা ছিল কম-বেশী তিন মাসের। তবে এটা পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে মুসা শুক্রবার দিন জুময়ার আজানের স্বল্প কিছুক্ষণ পূর্বে দামেস্কে পৌঁছেন।
দামেস্কের শহর চোখের সামনে ভেসে উঠল। তারেক ও মুগীছে রুমী মুসা। থেকে বেশ পিছনে ছিলেন, তাদের ঘোড়া চলছিল ধীর পদে। তারেক ও মুগীছের চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ ফুটে উঠেছিল। তার কারণ ছিল দামেস্কের কিছুটা অদূরে মুসার মত এক সম্মানী ও মর্যাদাবান আমীর এমন বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন যা তারেক ও মুগীছ আদৌ প্রত্যাশা করেন নি।